চোখ এখন চার সিটিতে

ডেস্ক রিপোর্ট: সব ঠিক থাকলে বছর শেষে জাতীয় নির্বাচন। আপাতত এ লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তার আগে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করে টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছে ইসি। এ পরীক্ষায় পাস-ফেলের হিসাব-নিকাশ কষছে দেশের মানুষ। বিরোধী পক্ষের দাবি খুলনায় ব্যর্থতাকে পুঁজি করেই ফিরেছে নির্বাচন কমিশন। দৃশ্যত নির্বাচন নিয়ে কে এম নূরুল হুদা কমিশন সন্তোষ প্রকাশ করলেও ভেতরের পর্যালোচনা ইসির জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না।

অনিয়মের কারণে তিনটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত এবং ইসির অভ্যন্তরীণ তদন্তে খোদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। অনিয়ম করেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর লোকজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল তাদের অনেকটা সহযোগী। খুলনার নির্বাচনের মাস পেরুতেই গাজীপুরে আরেক বড় পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ইসি বলছে, খুলনার ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না এ সিটিতে।

জাতীয় নির্বাচনের জন্য গাজীপুরকে তারা একটি মডেল নির্বাচন হিসেবে দাঁড় করাতে চান। এ লক্ষ্য নিয়ে নিজেদের ছক আর কৌশল নির্ধারণ করছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। ঈদুল ফিতরের দিন কয়েক পরেই গাজীপুরে ভোট। খুলনার সঙ্গে একই দিনে ভোটের তফসিল হলেও আদালতের আদেশে নাটকীয়ভাবে আটকে যাওয়া ও পরবর্তীতে নতুন নির্ধারণ হওয়া গাজীপুরের ভোট নিয়ে দেশবাসীর রয়েছে আগ্রহ। ঢাকার পাশে বড় এ সিটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শক্তিশালী প্রার্থী দিয়েছে। এ সিটির আগের নির্বাচনে বিএনপির দখল করা মেয়র পদটি নিজেদের করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারা ঘাম ঝরাচ্ছেন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এখানে আওয়ামী লীগের বড় সমস্যা অভ্যন্তরীণ কোন্দল। দলের জনপ্রিয় নেতা টঙ্গী পৌরসভার সফল মেয়র অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান গত নির্বাচনে হারের পর এবার দলীয় মনোনয়নের দৌড়েও হেরেছেন।

দলীয় প্রার্থী হয়েছে তরুণ প্রজন্মের নেতা জাহাঙ্গীর আলম। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বিরোধ অনেকটা প্রকাশ হয়ে পড়লে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে তা অনেকটা দৃশ্যত প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু আদতে সেই বিরোধ মেটার ওপরই নির্ভর করবে এ সিটিতে দলীয় প্রার্থীর জয়-পরাজয়। তবে পরিস্থিতি যাই হোক আওয়ামী লীগ এ সিটিতে দলীয় প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে চায়। নেতারা মনে করছেন জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব সিটিতে সুষ্ঠু ভোট করে যেমন সরকার পরীক্ষায় পাস করতে চায় তেমনি দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করে দলের জনপ্রিয়তার বিষয়টিও দেশবাসীর কাছে উপস্থাপন করতে চায়। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার শুরু থেকেই নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতের অভিযোগও আছে তার। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচন করে বিএনপি দেশবাসীকে দুটি বার্তা দিতে চায়। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে দলের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে চায় দলটি। আর নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বর্তমান কমিশন দিয়ে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয় এমন বার্তা দিতে চাইবে দেশবাসীকে। এমন অবস্থায় গাজীপুরে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় এক চ্যলেঞ্জ। গাজীপুরের নির্বাচনের এক মাসের মাথায় হবে আরো তিন গুরুত্বপূর্ণ সিটি নির্বাচন। ৩০শে জুলাই নির্বাচন হবে সিলেট, রাজশাহী ও বরিশালে। জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় আগে এই তিন সিটির নির্বাচন ইসির জন্য অনেকটা অগ্নি পরীক্ষার মতোই। এ তিন সিটির নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকেই চলবে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বিরোধের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ইস্যু হিসেবে সামনে আসবে কিনা তাও নির্ধারণ হবে এ তিন সিটির নির্বাচনে। ইতোমধ্যে গাজীপুরসহ চার সিটিতে ভোটের হাওয়া বইছে। মাঝপথে প্রচার প্রচারণা থেমে যাওয়া গাজীপুর সিটির প্রার্থীরা ঈদের পর সাত দিন সময় পাবেন প্রচারের। ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিক প্রচার প্রচারণা চলছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে মন্ত্রী-এমপিরা প্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ বিএনপির প্রার্থীর। ভোট বন্ধের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এবং পুলিশের মামলার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো পুরোদমে মাঠে ফিরেননি। ঈদের পরে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হলে হয়তো ফিরবেন।

নির্বাচন কমিশন বলছে এ সিটির জন্য তারা আলাদা কৌশল নির্ধারণ করেছেন। নিজস্ব তদারক দল বাড়ানো হবে। বেশি সংখ্যায় ম্যাজিস্ট্রেট দেয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও বাড়ানো হবে। ইসির এ প্রস্তুতি যদি কোনো কারণে বুমেরাং হয় তাহলে পরবর্তী তিন সিটির নির্বাচনেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বিএনপি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে গাজীপুরের অবস্থা দেখে পরবর্তী তিন সিটির নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ তিন সিটি নির্বাচনের মাঠে প্রার্থী ঠিক করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সিলেটে দুই দলেরই প্রার্থী অনেকটা চূড়ান্ত। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে লড়তে পারেন এ সিটির সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান। বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আবারও বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন এটা অনেকটা নিশ্চিত।

এই প্রার্থীকেই এখানে লড়তে হবে দলীয় কোন্দলের বিরুদ্ধে। এখন পর্যন্ত এ সিটিতে পরিবেশ শান্তিপূর্ণ হলেও দলীয় কোন্দল নির্বাচন পরিস্থিতে প্রভাব ফেলতে পারে স্থানীয়দের এমন শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্যও আওয়ামী লীগ বিএনপির প্রার্থী পুরনো মুখই। বর্তমান মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের হয়ে লড়বেন সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন। নগরীতে ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা শুরু করেছেন তিনি। তবে বিএনপির প্রার্থী এখন চুপচাপ। দলটির নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী নিয়ম ভেঙে প্রচারণা চালাচ্ছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। বরিশালের অবস্থা অবশ্য একটু ভিন্ন। এ সিটিতে দু্‌ই দলেই প্রার্থী নিয়ে জটিলতা আছে। দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ায় নির্বাচন নিয়েও খুব একটা আলোচনা নেই। তবে প্রার্থী যেই হোন না কেন বিএনপির হাতে থাকা এ সিটির মেয়র পদটি নিজেদের আয়ত্তে আনতে কঠিন লড়াইয়ে নামতে হবে বিএনপিকে। সাধারণ বরিশালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য করতে নিজেরে সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। সমানভাবে আইন প্রয়োগের বিষয়ে তাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

উল্লেখ্য, সিলেট সিটিতে সর্বশেষ ভোট হয়েছে ২০১৩ সালের ১৫ই জুন। এ সিটির মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী ৮ই অক্টোবর। একই দিনে রাজশাহী সিটিতেও ভোট হয়। তবে এ সিটির মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী ৫ই অক্টোবর। একই দিনে ভোট হওয়া বরিশাল সিটির মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী ২৩শে অক্টোবর। ২০১৩ সালের একই দিনে খুলনা সিটিতেও নির্বাচন হয়েছিল। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে এ চার সিটিতে সুষ্ঠুভাবে ভোট করতে পেরেছিল আগের নির্বাচন কমিশন। চার সিটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে চমক দেখান বিএনপির প্রার্থীরা।