কলকাতায় মেট্রোতে যা হলো

ফ্যাশন ডিজাইনের ক্লাস শেষে আমি রোজই এসপ্ল্যানেড থেকে মেট্রো ধরি। এক এক দিন এক এক সময়ে। কিন্তু, সেই মেট্রোতেই যে এমন অভিজ্ঞতা হবে স্বপ্নেও কোনও দিন ভাবিনি। মঙ্গলবার আমার সঙ্গে যা হল, তার পর মেট্রোতে উঠতেই ভীষণ ভয় লাগছে।

তখন বিকেল ঠিক চারটে। কবি সুভাষগামী একটা এসি মেট্রো এসে দাঁড়ায় এসপ্ল্যানেড স্টেশনে। তেমন একটা ভিড় ছিল না। আমার পিছনে বেশ কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরাও ওই মেট্রোতেই ওঠে। ওদের সকলের বয়স ২০-২৫ বছর হবে।

কিন্তু, ওঠার পর থেকেই ওরা রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে আমাকে। এমন ভাব, যেন ভিড়ের চাপ সামলাতে না পেরে গায়ে এসে পড়ছে। কিন্তু, অতটা ধাক্কাধাক্কি করা বা গায়ে এসে পড়ার মতো ভিড় মোটেই ছিল না। আমি একটা পাশে সরে দাঁড়াই। তার পরেও দেখি একটা ছেলে রীতিমতো গায়ে এসে পড়ছে। খুব অস্বস্তি হতে থাকে। তাই কথাটা না বলে পারিনি— ‘কী হল, সুস্থ ভাবে দাঁড়াতে পারছ না? গায়ে পড়াটা এতই দরকার?’ আর ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা ছেলে মন্তব্য করল, ‘‘এটা মেট্রো। এখানে অনেক কিছু হতে পারে।’’

ওই কথাবার্তা শুনে সামনে বসে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘‘ওদের সঙ্গে কথা বলতে হবে না। ছেড়ে দাও। আমি উঠে দাঁড়াচ্ছি। তুমি এসে বসো আমার জায়গায়।’’ উনি উঠে গিয়ে আমাকে জায়গাটা দেন। আমি বসে পড়ি। কিন্তু, তাতেও পরিস্থিতি বদলায়নি। নানা রকমের অশালীন মন্তব্য উড়ে আসছে। তখন দেখলাম, ওরা সংখ্যায় ১০ জন। মেট্রোয় ভর্তি লোকজন। ওরা কি অবলীলায় খারাপ খারাপ মন্তব্য করে যাচ্ছে আমাকে! আশপাশে কত জন দাঁড়িয়ে, বসে। অথচ একটা কেউ কোনও কথা বলছেন না! ওদেরকে কিছু বলা তো অনেক দূরের ব্যাপার।

এক একটা স্টেশন পার হচ্ছে, ওদের অসভ্যতার মাত্রা যেন ক্রমশ বাড়ছে। ওদের উল্টোপাল্টা কথা, নোংরা শব্দ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী— একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। আশপাশের সকলের কানে যাচ্ছে সে সব, অথচ, এক জনকেও এগিয়ে এসে ওদের কিছু বলতে দেখলাম না। আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না। নামার কথা ছিল শহিদ ক্ষুদিরামে। কিন্তু, মহানায়ক উত্তমকুমারেই নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই।

কিন্তু নামব কী! ওদের এক জন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। অন্য এক জন আমার পাশে! তখনও কিছু বলিনি। চুপচাপ ছিলাম। ভাবলাম, ওরা সরে গেলেই নামব। আর ঠিক তখনই পিছন থেকে খুব বাজে একটা শব্দ ভেসে এল আমার উদ্দেশে। তাকিয়ে দেখলাম, ওদেরই এক জন। আমি তাকাতেই সে ওই শব্দটা ফের উচ্চারণ করে বলল, ‘‘এই সরে যা! নামতে দে ওকে।’’ নামতে যাব, দেখি আমার হাতের শপিং ব্যাগটা কে যেন টেনে ধরেছে। আমাকে নামতেই দেবে না তবে! খুব রাগ হয়ে যায়। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে একটা চড় মারলাম। তার পর কোনও রকমে ওর হাত থেকে ব্যাগটা ছাড়িয়ে আমি মেট্রো থেকে নামি।

ওরাও নেমে পড়ল মেট্রো থেকে। এ বার প্ল্যাটফর্মের উপরেই আমাকে ঘিরে ধরল ওরা। ভাবটা এমন, যেন আমাকে মারবে! সে কী হাবভাব ওদের। এমন সময়ে দেখি, মেট্রো স্টেশনের কর্মীরা ছুটে আসছেন। তাঁদের মধ্যে এক জন আমাকে বাঁচান। পরে জেনেছি, ওঁর নাম পার্থ। ওঁর জন্যই আমি ওই ১০টা ছেলেকে গ্রেফতার করাতে পেরেছি। উনি এসে আমাকে ওই ১০টা ছেলের সঙ্গে নিয়ে যান স্টেশন মাস্টারের ঘরে। খবর দেওয়া হয় মহিলা পুলিশকে। এক জন আসেন। তিনি আমার কাছে ঘটনাটা শোনেন। এর পর ওঁদের তরফে রিজেন্ট পার্ক থানায় জানানো হয়। সেখান থেকে অফিসাররা আসেন। ওঁরা ফের পুরো ঘটনার কথা শোনেন। সবাইকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের তরফে আমাকে বলা হয়, যদি ওদের শাস্তি দিতে হয় তবে আমাকে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। আমি সেটাই করি। তার ভিত্তিতে ওই ১০টি ছেলেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পর আমি রাত ৯টা নাগাদ বাড়ি ফিরি।

কিন্তু, একটা ভয় করছে। আসলে, ক্লাসে যাওয়ার জন্য তো রোজই মেট্রোয় উঠতে হবে! ক্লাস না হয় ছেড়েই দিলাম, শহরে থেকে মেট্রোতে আর চড়ব না এমনটা বলা তো সহজ নয়! কিন্তু, কী করে চড়ব! আশপাশের একটা মানুষও যদি পাশে দাঁড়াতেন, তা হলে ব্যাপারটা এত দূর এগোতোই না। মনে এতটা ভয়ও হত না। একটা সাপোর্ট পেতাম হয়তো! এখানে শুধু কয়েক জন মেট্রো আর রেলকর্মীকে সক্রিয় হতে দেখলাম। ওঁদের জন্যই ১০টা ছেলে গ্রেফতার হল।

আমি ওই ছেলেগুলোর শাস্তি চাই। ওরা যাতে ভবিষ্যতে অন্য কারও সঙ্গে এই ব্যবহারটা না করতে পারে। আজকে আমার সঙ্গে হয়েছে, আমি প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু এখনও অনেক মেয়ে আছে, যারা চুপ করে তাকে। কিছু বলতে পারে না। আমি তাদের একটা অনুরোধ করব, এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদেরকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।

সূত্র- আনন্দবাজার