ব্যাংকগুলোর ৩ বছরের তথ্য চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

bangladesh bank

গত তিন বছরে ব্যাংক থেকে কারা ঋণ পেয়েছে, কাদের সুদ মওকুফ করা হয়েছে, কোন কোন গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো সময়মতো ঋণের টাকা আদায় করতে পারেনি, কারা এ সময়ে খেলাপির তালিকায় নাম লিখিয়েছে— এসব তথ্য জোগাড় করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে তিন বছরের বিভিন্ন ধরনের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য তাদের চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চিঠির উত্তর পাওয়ার পর প্রকৃত অবস্থা জানতে বড় কয়েকটি ব্যাংক পরিদর্শন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য কয়েকটি পরিদর্শন দল গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগের (এফআইসিএসডি) এক ডিজিএমের নেতৃত্বে এ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাংক থেকে গত তিন বছরে ঋণ পাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে তথ্য চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে ওইসব গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের পাওনা এবং তা আদায়ে ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগের তথ্যও চাওয়া হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে খেলাপির সংখ্যা কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে ব্যাংকগুলোতে বিশেষ পরিদর্শন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’

ব্যাংকগুলোর কাছে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে

জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর কাছে পাঠানো চিঠিতে ২৩ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— গত তিন বছর ব্যাংক খাত থেকে কারা ঋণ পেয়েছেন। এই সময়ে ব্যাংকগুলো কাদের সুদ মওকুফ করেছে। সুদ মওকুফের পরিমাণ কত। ব্যাংকগুলো কোন কোন গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না। এই তিন বছরে কারা খেলাপির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। শীর্ষ ২০ খেলাপি তালিকা। শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে ব্যাংকের পাওনা কত টাকা। গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের পাওনা আদায়ে ব্যাংকের নেওয়া কী কী উদ্যোগ ছিল, বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা এবং মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগগুলো কী কী ছিল, এসব জানাতে বলা হয়েছে। এছাড়া, বড় অংকের ঋণগ্রহীতাদের জামানতের তথ্য ও বিভিন্ন কাগজপত্র পাঠাতে বলা হয়েছে। এই তিন বছরে কী পরিমাণ ঋণ অবলোপন হয়েছে, কোন কোন গ্রাহকের ঋণ অবলোপ হয়েছে— তার তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মন্তব্য প্রতিবেদনও পাঠাতে বলা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি ঋণের বিষয়ে ব্যাংকের সম্পদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (এলকো) মতামত, ঋণ নেওয়া গ্রাহকদের আবেদন, শাখার মূল্যায়ন, প্রধান কার্যালয়ের মূল্যায়ন, পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, মঞ্জুরিপত্র, প্রকল্প পরিদর্শন প্রতিবেদন, সহযোগী জামানতের মূল্যায়ন, আইনগত মতামত, ডকুমেন্টেশন, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্টের মূল্যায়ন, বহিঃনিরীক্ষা প্রতিবেদনের মতামত পাঠাতে বলা হয়েছে।

ভালো ও মন্দ গ্রাহক বাছাই হবে

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক খাতে সুবিধা নেওয়া গ্রাহকদের মধ্যে ভালো গ্রাহক ও মন্দ গ্রাহক বাছাই করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকটি নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ শ্রেণিকরণ ও সঞ্চিতি সংরক্ষণের নীতিমালায় পরিবর্তন এনে ঋণখেলাপিদের নতুন করে সুযোগ করে দিয়েছে, যা কার্যকর হবে আগামী জুন থেকে। এর আগে ২ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, ঋণখেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ শোধ করতে পারবেন। তবে এজন্য তাদের এককালীন ২ শতাংশ টাকা জমা দিতে হবে। তবে যারা ঋণ নিয়ে নিয়মিত টাকা ফেরত দিচ্ছেন, তাদের জন্য কোনও সুখবর নেই।

যেসব ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য প্রথম পর্যায়ে ১১টি ব্যাংক পরিদর্শন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ পরিদর্শনের জন্য কার্যক্রমের দিক থেকে তুলনামূলক বড় ব্যাংকগুলোকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো হলো— জনতা, এবি, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ওয়ান, এনসিসি, ব্র্যাক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, শাহজালাল, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল ও ইস্টার্ন ব্যাংক।

আসছে ঋণ পুনঃতফসিলের নতুন সুযোগ

যারা চিহ্নিত ঋণখেলাপি, তারা অচিরেই ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ পাবেন। মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই পুনঃতফসিল করা যাবে। পুনঃতফসিল হওয়া ঋণ পরিশোধে তারা সময় পাবেন টানা ১২ বছর। এর মধ্যে প্রথম ২ বছর কোনও কিস্তিই পরিশোধ করতে হবে না। এসব খেলাপি ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়া শুরু করলে পাবেন সুদের বিশেষ সুবিধা। নিয়মিত গ্রাহকদের চেয়েও তাদের কম সুদ গুনতে হবে। ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহকদের ওপর ১২ থেকে ১৬ শতাংশ হারে সুদারোপ করা হলেও চিহ্নিত ঋণখেলাপিদের জন্য সুদারোপ হবে মাত্র ৯ শতাংশ হারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নবায়ন করা হয়। এর বাইরে হিসাব থেকে বাদ দিতে অবলোপন করা হয়েছে আরও ৩ হাজার ২০১৭ কোটি টাকা। এরপরও গত বছর খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় ডাউন পেমেন্ট ও মেয়াদের শর্ত শিথিল করে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নেওয়া ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপকে দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা। ওই সময় তারা ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই পুনর্গঠিত ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় সুদে-আসলে ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাংক খাত ঠিক করা দরকার। আর এই খাত ঠিক করতে হলে আগে দরকার সুশাসন। এই সুশাসন আনা সম্ভব হলে এমনিতেই খেলাপি কমে আসবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, খেলাপিদের জন্য এত সুবিধা না দিয়ে যারা নিয়মিত টাকা ফেরত দেয়, তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘এক শ্রেণি আছে তারা ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে পুনঃতফসিলের সুযোগ খোঁজে। আবার ব্যালেন্সশিটে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে ব্যাংকগুলোও ঢালাওভাবে বড় কিছু গ্রাহককে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়।’