বাংলাদেশের দুই উদযাপনে অংশীদার ‘হতে চায়’ ভারত

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে অংশীদার হতে চায় ভারত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুক্রবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে এক বৈঠকে যৌথভাবে ওই আয়োজনের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদিন জানান।

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার দিল্লি যান রাষ্ট্রপতি হামিদ। শুক্রবার দিল্লীর হায়দ্রাবাদ হাউজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে তাকে অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রপতি।

বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদিন আলোচনার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানান।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে দুই দেশ যৌথ উদ্যোগ নিলে তা আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব পাবে বলে মত প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রেও তা ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।”

আসছে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মের শত বছর পূর্ণ হবে। আর ঠিক পরের বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশ উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার ঠিক আগে আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর শুরু হয় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ওই যুদ্ধে কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা শহীদ হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকারে ফেরার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মাননা জানানো হয়। পরবর্তীতে সম্মাননা পান ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপায়ী এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি।
২০১৫ সালের ৭ জুন বাংলাদেশ সফরে এসে বাজপায়ীর পক্ষে সেই সম্মাননা স্মারকটি নেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদিন বলেন, নরেন্দ্র মোদী আবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় বৈঠকে তাকে অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

“তিনি বলেন, ভারতের জনগণ তার (মোদী) প্রতি যে আস্থা রেখেছে, সেই প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারবেন।”

প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার তরফ থেকেও নরেন্দ্র মোদীকে শুভেচ্ছা জানান রাষ্ট্রপতি। সেই সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান তিনি।

“রাষ্ট্রপতি বলেন, পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি থাকায় প্রধানমন্ত্রী নিজে আসতে পারেননি। তবে তিনি এবং বাংলাদেশের জনগণ নরেন্দ্র মোদীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।”

প্রেস সচিব বলেন, “রাষ্ট্রপতি শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি তাকে স্পর্শ করেছে। আর দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে এবং সেজন্য দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।”

দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ‍ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টিও এদিন আলোচনায় আসে। ভারতে কংগ্রেস আমল থেকে আটকে থাকা ওই চুক্তির জট ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় যাওয়ার পরও খুলতে পারেননি মোদী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে বিষয়টি ঝুলে আছে।

প্রেস সচিব বলেন, “বাংলাদেশের জনগণ যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির সমাধানের বিষয়ে গভীরভাবে আগ্রহী, সে কথা রাষ্ট্রপতি বৈঠকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তিস্তা বাংলাদেশের জনগণের লাইফ লাইন। রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেন, আগামী দিনে এই সমস্যার সমাধান হবে। নরেন্দ্র মোদীর নতুন সরকারের অধীনে আগামী ৫ বছরে দুই দেশের নিস্পত্তি না হওয়া বিষয়গুলোর সমাধান হবে।”

“বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, তিস্তাসহ দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়টির সমাধান হওয়া উচিৎ বলে ভারত মনে করে। সেজন্য যৌথ নদী কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।”

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এ সমস্যা শুধুমাত্র বাংলাদেশর একার নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নিরাপত্তা হুমকি। এ সমস্যার সাধাধানে ভারতের ভূমিকা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ভারত এ সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

নরেন্দ্র মোদী বলেন, ভারতও মনে করে এটা বাংলাদেশের একার সমস্যা না। একটি সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ভারত সব সময় আন্তর্জাতিক ফোরামে সোচ্চার থাকবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন।
রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশর সঙ্গে ভারতের এই সম্পর্ক পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ মোদীর নেতৃত্বে গত ৫ বছরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে নিরাপত্তা, জ্বালানি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কৃতি, জনগণের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ, ব্লু ইকোনমিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ অগ্রগগিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন আবদুল হামিদ।

তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের অনিস্পন্ন ছিটমহল ও সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিস্পত্তির কথা স্মরণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জঙ্গি ও উগ্রবাদের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ কখনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের বাংলাদেশের সীমানা ব্যবহার করে অন্য দেশের বা জনগণের ক্ষতি করতে দেবে না।

সম্প্রতি ভারতের ওপর দিয়ে তৃতীয় দেশ থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় নীতি শিথিল করায় নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানান রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, এর ফলে জ্বালানি খাতে ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে।

আব্দুল হামিদ ও নরেন্দ্র মোদী উভয়েই দুই দেশের বাণিজ্য বিনোয়োগ সম্পর্ক নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন বলে জয়নাল আবেদিন জানান।

দিল্লীর হায়দ্রাবাদ হাউজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরপরই দেশে ফেরার জন্য বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হন রাষ্ট্রপতি হামিদ। শুক্রবার বিকালেই তিনি ঢাকা পৌঁছাবেন।