নিশোর নিশো হয়ে উঠার গল্প

টিভি নাটকের এই সময়ের অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা আফরান নিশো। তার অভিনয় জাদুতে মুগ্ধ দর্শক। গল্পের চরিত্র যেমনই হোক, নিজেকে তিনি এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যেন তাকে ঘিরেই এ চরিত্রের সৃষ্টি। র‌্যাম্প মডেলিং থেকে শুরু করে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন- সবই তিনি করেছেন। অভিনয় জীবনের আদ্যোপান্ত নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন নন্দনের সঙ্গে-

ভবঘুরে, মাস্তান, রাজাকার, জোকার, খামখেয়ালি, উচ্ছৃঙ্খল, গোয়েন্দা, ছিঁচকে চোর- আফরান নিশোকে লোকে অনেক নামেই ডাকে। আসলে তিনি কেমন, তা বোঝা দুস্কর। কারণ সব সময় তিনি কোনো না কোনো চরিত্র ধারণ করছেন। ফলে বলা যায় আফরান নিশো একটি প্রহেলিকার নাম। কোনটি তার আসল রূপ আর কোনটি অভিনয়, ধাঁধায় ফেলে দেয় দর্শককে। গত ১০ বছরে টিভি মিডিয়ায় নিজের একটা অবস্থান তৈরি করেছেন, যা বেশ ঈর্ষণীয়। আজ উত্তরা তো কাল পুবাইল, নয়তো অন্য কোনো জায়গায় শুটিংয়ে ব্যস্ত দিন কাটে তার। দিন-রাত এত ব্যস্ত সময় কাটে; ক্লান্তি এসে কখনও ভর করে না?

নিশো বললেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাকে কাজের সময় বেশি এনার্জি দিয়ে রেখেছেন [হাসি]। ছোটবেলায় মা-বাবাকে সব সময় একই কথা শুনতে হতো- আপনার ছেলের মধ্যে এনার্জি ভরপুর। যতই পরিশ্রম করতাম না কেন, কখনও ক্লান্ত হতাম না। এখনও সে অভ্যাস বিদ্যমান। শুটিংয়ে যতই চাপ থাকুক; বাসায় এসেও পরিবারের জন্য নিজের শতভাগ দিতে চেষ্টা করি। আমি সব সময় আজকের জন্য বাঁচি। কাল কী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে বিশেষ দিবস ও উৎসব আয়োজনে যেন দম ফেলার ফুরসত থাকে না। তখন নিজের ওপর দিয়ে অন্যরকম চাপ বয়ে যায়। এটাও মাঝেমধ্যে উপভোগ করি। এমনও হয়েছে, ভালোবাসা দিবসের কাজের জন্য মাসে ৩০ দিনই শুটিং করতে হয়েছে।’

সময়ের সঙ্গে সবকিছুই বদলে যায়। বদলেছে নাটক প্রচারের মাধ্যমও। সাধারণত টেলিভিশনে প্রচারের জন্যই নাটক তৈরি হতো এতদিন। ইউটিউব আসার পর সেই নাটকগুলো টেলিভিশনে প্রচারের পর ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার হতো। এখনও এ ধারা চলছে। তবে বছরখানেক ধরে উল্টোচিত্র দেখা গেছে টেলিভিশন মিডিয়ায়। এখন ইউটিউবের জন্যই বানানো হচ্ছে নাটক। এগুলোতে অভিনয় করছেন জনপ্রিয় তারকা শিল্পীরা। অভিনেতা আফরান নিশোও তাদের একজন। চলতি মাসের শুরুতেই ধ্রুব টিভির ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পেয়েছে তার অভিনীত নাটক ‘অনলি মি’। এতে তার সহশিল্পী ছিলেন তানজিন তিশা। মুক্তির পরপরই নিশোর অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।

নিশো বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে বিনোদনের মাধ্যমও বদলে গেছে। দর্শক এখন চাইলেই ইউটিউবে যে কোনো নাটক দেখছেন। এ মাধ্যমে প্রচারিত নাটকে অন্য রকম সাড়া পাওয়া যায়। গল্প ও চরিত্র মিলে ‘অনলি মি’র কাজটি অসাধারণ। অনেকেই নাটকটি দেখে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আর নিজেও কাজ করে তৃপ্ত হয়েছি। এ ছাড়াও গত ঈদে একই নির্মাতার ‘মুঠোফোন’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করেছেন নিশো। এ নাটকের গল্প ভাবনা তারই।

ছোট পর্দায় যার রাজত্ব সেই নিশোকে এখনও দর্শক বড় পর্দায় দেখতে পায়নি। নিশো বলেন, চলচ্চিত্রে আমিও অভিনয় করতে চাই। যে ধরনের চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে চাই, সে ধরনের পাচ্ছি না। অভিনয়ের জন্য অনেক প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু নানা কারণে তা প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে।

চলচ্চিত্র জগৎটি টেলিভিশনের চেয়ে অনেক বড় প্ল্যাটফর্ম এবং সে প্ল্যাটফর্মের জন্য নিজেকে আরও প্রস্তুত করা দরকার। অনেক দিন আগে আমাকে একটি চলচ্চিত্রের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। চরিত্রটি আমার পছন্দ হয়েছিল। প্রস্তুতিতে আমি ছয় মাসের জন্য সময় দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম নির্মাতাকে। তবে চলচ্চিত্র নির্মাতা যেহেতু এতটা সময় পাননি, তাই আমাকে প্রস্তাবটি বাতিল করতে হয়েছিল। আমাকে যে চরিত্রগুলোর প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে সেগুলো আমার জন্য উপযুক্ত হতে হবে। আমি তখনই চলচ্চিত্রে কাজ করব যখন এসব কারণ আমার প্রত্যাশার সঙ্গে মেলে। সবাই খুব তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে চায়। আমি তা পারব না। আমি একটা সিনেমা করব, যেন মৃত্যুর আগে বড় গলায় বলতে পারি- এটা আমার সিনেমা।

নিশোর জন্ম টাঙ্গাইলে। কিন্তু ধুলোমাখা শৈশব সেখানে কাটাতে পারেননি। খুব ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে পাড়ি জমান ঢাকায়। এর পর রাজধানীতেই কেটেছে তার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। শোবিজে কাজ করবেন, এমনটি কখনও ভাবেননি নিশো। ২০০০ সালে হঠাৎ একটি বুটিক হাউসের মডেল হওয়ার প্রস্তাব পান। এর পর বিভিন্ন পণ্যের মডেল হওয়ার পাশাপাশি র‌্যাম্পেও কাজ শুরু করেন। ২০০৩ সালে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে তিনি প্রথম কাজ করেন। এর পর দেশসেরা কয়েকজন নির্মাতার বিজ্ঞাপনে তাকে দেখা যায়। গাজী রাকায়েতের পরিচালনায় ‘ঘরছাড়া’ দিয়ে টিভি নাটকে তার অভিষেক। প্রথমে নাটকে সিরিয়াস ছিলেন না নিশো। তবে মানুষের একটা কথাই তার ক্যারিয়ারকে বদলে দিয়েছে। জেদেই নিশো আজ অন্যরকম এক অভিনেতায় পরিণত হয়েছেন। অপেক্ষার ফটোগ্রাফি, আঁধার ও আলো, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, চলো না বৃষ্টিতে ভিজি, লোটাকম্বল, বিয়ে পাগল, আমি দেবদাস হতে চাই, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেমের গল্প প্রভৃতি নাটকে অভিনয় দিয়ে নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি।

নাটকের ক্যারিয়ার নিয়ে নিশো বলেন, ‘অনেক সময় জেদেরও জয় হয়। এটা আমার ব্যক্তিজীবন থেকেই উপলব্ধি করেছি। আশপাশের লোকের একটা কথা আমাকে বদলে দিয়েছে। ক্যারিয়ারের শুরুতে মডেলিংয়ে বেশ মনোযোগী ছিলাম। এর পর অভিনয়ে আসি। যখন নাটকে কাজ শুরু করি তখন নাকি মানুষ বলত, মডেলরা ভালো অভিনেতা হতে পারে না। ব্যস, এ কথাই জেদ হয়ে চাপল মাথায়। এর পর হয়ে যাই অভিনয়ে মনোযোগী এক মানুষ।’

নিশো আজ তারকা অভিনেতা হয়েছেন। তারকাখ্যাতি কতটা, তার অভিনীত নাটক আর ইউটিউবে থাকা নাটকগুলোর নিচে মন্তব্য পড়লেই বোঝা যায়। ‘লোটাকম্বল’ নাটকে তার অসাধারণ অভিনয় এখনও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে। নাটকটি ২০১৪ সালে গাজী টিভিতে প্রচার হয়েছিল। এ নাটকে তিনি প্রথমবার ভার্চুয়াল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লোটাকম্বল উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটি নির্মাণ করেছেন গোলাম মুক্তাদির শান। নিশো বলেন, ‘লোটাকম্বল নাটকে চরিত্রটি ছিল অসাধারণ। এ ধরনের নাটকে প্রথম অভিনয় করেছিলাম। চরিত্রটির বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।

কখনও হাসি, কখনও কেঁদে উঠি, আবার কখনও রেগে যাই। নাটকে কাজ করতে গিয়ে মিশ্র সব অভিব্যক্তি দিতে হয়েছে আমাকে। এ ধরনের নাটকে অভিনয় করা নিয়ে মনে এক ধরনের সংশয় থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটা ছিল। কারণ, কাজটি সবার পছন্দসই হবে তো? কিন্তু নাটকটির দর্শক-সাড়া দেখে সব সংশয় দূর হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই বলে থাকেন, নিশো ছোট পর্দায় বেশ জনপ্রিয়। এ অন্য রকম উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার মন্ত্র কী? দেখুন, আমি আমার কাজটি ঠিকঠাক করতে চাই। আমার ভক্তরা বলে যে, তারা আমার অভিনয়কে বাস্তব মনে করে। সম্ভবত, অন্য কারণটি হলো, আমি সর্বদা নানা চরিত্রে দর্শকের সামনে হাজির হওয়ার চেষ্টা করি। আমার মনে আছে, এক প্রবীণ শিল্পী একবার আমাকে বলেছিলেন, যদি আমি বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে দর্শকদের সামনে হাজির হই তাহলে সহজে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সক্ষম হবে। এটি আমার অভিনয়ের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। সেই থেকে আমি ভালো গল্প ও চরিত্র নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। এমনকি আমি নেতিবাচক ভূমিকায়ও অভিনয় করেছি। মূলধারার অনেক অভিনেতা নেতিবাচক ভূমিকা নিতে দ্বিধাবোধ করতে পারে। কিন্তু ভালো গল্পে যে কোনো চরিত্রে অভিনয়ে আমার আপত্তি নেই- বললেন নিশো।

নিশোর পুরো নাম আহমেদ ফজলে রাব্বী নিশো। নিশো নামের জনপ্রিয়তার কাছে এ নামটি অনেকেরই অজানা। পুরো নামের শব্দলোর আদ্যাক্ষর নিয়ে নিজেই ‘আফরান নিশো’ রেখেছেন। ব্যক্তিজীবনে সুখী মানুষ তিনি। স্ত্রী, সন্তান ‘নির্ভান’কে নিয়ে তার সুখের পৃথিবী। অভিনেতা ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই তার। আর নিজেও চান না অন্য কোনো পরিচয় তার থাকুক। কারণ শুধু অভিনয়কেই ভালোবাসেন তিনি। এই ভালোবাসা নিয়েই যেতে চান বহুদূর।