দেশের ২৩ জেলা এইডস ঝুঁকিতে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঘোষিত ‘নো ইয়োর স্ট্যাটাস’ অথাৎ এইচআইভি পরীক্ষা করুন; নিজেকে জানুন’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য ধারণ করে সারাবিশ্বের মতো গতকাল রোববার দেশেও নানা আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয়েছে। এসবের মধ্যে ছিল কৃষিবিদ ইনস্টিউিশনে র‌্যালি, আলোচনা সভা ও পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশসহ রেডিও-টেলিভিশনে বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার। এইডস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, প্রবাসী এবং বিদেশ থেকে আসা অন্যদের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে বেশি। সারা দেশের ২৩ জেলায় এইচআইভি (এইডস) আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি বাড়ছে। জাতিসংঘের এইডস কমর্সূচির পরিসংখ্যান হিসেবে দেশে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা হওয়ার কথা ১৩ হাজার ২০০ জন বলে জানা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস-এসটিডি প্রোগ্রাম (এএসপি) সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৬ জন। সে হিসেবে শনাক্তের বাইরে রয়েছে ৭ হাজার ৬১৬ জন। দেশে এইডসে আক্রান্ত রোগীর মোট সংখ্যা ৫ হাজার ৮৬৫ জন। এর মধ্যে ৩০০ শিশু আছে। এ পর্যন্ত দেশে ৯২৪ জন এইডস রোগী মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির কর্মকর্তারা বলছেন, এইচআইভি আক্রান্তদের ৫০ শতাংশ জানেনই না যে তাদের এই রোগ হয়েছে। যারা জানেন, তাদের একতৃতীয়াংশের বেশি চিকিৎসা নেন না। এদিকে অভিবাসনের মাধ্যমে দেশে এইচআইভি/এইডস ছড়িয়ে পড়ছে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এইচআইভি আক্রান্তদের ৩০ শতাংশেরও বেশি অভিবাসী অথবা তাদের পরিবারের সদস্য। অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, একই সুচ ব্যবহার করে শিরায় মাদক গ্রহণসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এইডস সংক্রমণ হলেও অভিবাসনের মাধ্যমে সংক্রমণের ঘটনা নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাএখনই রোগটির মোকাবিলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিকিৎসাসেবার পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস-এসটিডি প্রোগ্রাম (এএসপি) সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে বেশি ঝুঁকি চিহ্নিত ২৩টি জেলার মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে ৯৪৭, গাজীপুরে ১৬৯, নারায়ণগঞ্জে ১৫২, মুন্সীগঞ্জে ২০৮, ময়মনসিংহ জেলা সদরে ৫২, কিশোরগঞ্জে ২৬, বরিশাল জেলা সদরে ৬১, পটুয়াখালীতে ৩৫, চট্টগ্রাম জেলা সদরে ৫৪২, কক্সবাজারে ১৯৭, কুমিল্লায় ৩২৫, চাঁদপুরে ১৫৩, সিলেট জেলা সদরে ৭৩৭, মৌলভীবাজারে ১৮৫, দিনাজপুরে ৩১, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে ১২, বগুড়ায় ২৮, পাবনায় ৪১, সিরাজগঞ্জে ১৮, খুলনা সিটি কর্পোরেশনে ১৭২, বাগেরহাটে ২৩, যশোরে ১৩১ ও সাতক্ষীরায় ৬৪ জনসহ দেশের ২৩টি জেলায় ৪ হাজার ৩০৯ জনকে এইচআইভি পজেটিভ শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভাগীয় অঞ্চলে আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে এইডস রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৯১, চট্টগ্রামে ১ হাজার ৬৭১, সিলেটে ১ হাজার ৬২, খুলনায় ৫০৩, বরিশালে ১৩৭, রাজশাহী ১৪৪, রংপুরে ৫৩ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বতর্মানে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়লেও দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এইচআইভি ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে এএসপির সিনিয়র ম্যানেজার আখতারুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই দেশে এইচআইভি-এইডস নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক ধরনের কমর্সূচি চালানো হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় গতকাল ১ ডিসেম্বর থেকে ঝুঁকিপূণ ২৩টি জেলায় এইচআইভি টেস্টিং সেন্টার চালু করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন বৈশ্বিক পরিসংখ্যান হিসেবে বাংলাদেশে এইচআইভি-এইডসের বিস্তার মোট জনসংখ্যা অনুপাতে শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশের নিচে। যা তেমন উদ্বেগজনক নয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের টিবি-এল (টিউবারকোলসিস অ্যান্ড লেপ্রোসি) ও এএসপির (এইডস-এসটিডি প্রোগ্রাম) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে বলেন, এইডস মানে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া এক সময় এমন মনে করা হলেও এখন এ ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। কারণ আক্রান্তরা চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। বিদেশ ফেরৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইডস সম্পর্কে অসচেতনতা ও আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ লুকানোর প্রবণতায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে তাদের মাধ্যমে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ছে। প্রবাসীদের মাধ্যমে যেন এইডস না ছাড়ায় সে জন্য বিমানবন্দরকে কীভাবে টেস্টের আওতায় আনা যায় তা নিয়ে কাজ চলছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনও অভিবাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এইডস সংক্রমণের হার বাড়ছে বলে জানিয়েছে। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সালমান আদমান বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের সন্ধানে যাওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে বাংলাদেশে এইডস ছড়িয়ে পড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ও সরকারি-বেসরকারি অর্থায়ন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশে এইডস আক্রান্তের ঝুঁকি হ্রাসের পাশাপাশি চিকিৎসা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সমাজ বিশ্লেষক লাভলী শাসুন্নাহার বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমিত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নতুন করে উদ্বেগের জš§ দিয়েছে। এ পর্যন্ত এইচআইভি আক্রান্ত ৩৬৮ জন রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২০ জনকে বিনামূল্যে কক্সবাজার আড়াইশ’ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এসটিডি প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, বিদেশে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার কারণে অনেকে এইচআইভিতে আক্রান্ত হন। সে কারণে সতর্ক থাকার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে কর্মীদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যশিক্ষা দিতে হবে, যেন তারা এইডসে আক্রান্ত না হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই অভিবাসীদের মাধ্যমে নতুন করে এইচআইভি পজিটিভ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, আক্রান্তদের শতকরা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই হচ্ছে বিদেশ ফেরৎ, তাদের স্ত্রী এবং সন্তানরা। আবার প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

এইচআইভি পজিটিভ মায়ের সন্তানদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বলেন, মায়ের থেকে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৩০ শতাংশ। আর যদি মাকে ওষুধ দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে হার নেমে আসে পাঁচ শতাংশে। আবার যদি মা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাহলে তা বেড়ে ১০ শতাংশে চলে যায়।

এইচআইভি পজিটিভ হওয়া মায়েদের ৭০ শতাংশ সন্তান কেন পজিটিভ হবে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করে ভাইরাল লোডের (রক্তে ভাইরাসের পরিমাণ) ওপর। যদি ভাইরাল লোড কম থাকে, তাহলে বেঁচে যাবে। আর যদি বেশি ভাইরাল লোড বেশি থাকে তাহলে সন্তানের সংক্রমণের শঙ্কা থেকে যায় বলে জানান তিনি।