শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি (পর্ব-০২)

করোনাকালে শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্যই পিতামাতার কাজে সাহায্য করতে হবে

khairul bashar

আমাদের গর্বের বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাাসদ্রা মিলে প্রায় পৌনে ৫ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে যা বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। করোনা সংক্রমণের চলমান বৈশ্বিক মহামারীর দুঃসময়ে জনসংখ্যার এই বিরাট অংশের পিতা-মাতার প্রতি, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রতি, দায় রয়েছে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও এই দুঃসময়ে অলস সময় কাটানো যাবে না। মনোবল হরানো যাবে না।

দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে, নিজে সচেতন থেকে পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, সহপাঠি, বন্ধু-বান্ধবদেরও করোনা সংক্রমণ থেকে সচেতন করার পাশাপাশি এই দুঃসময়ে পিতামাতাকে বাড়ির কাজে সহযোগিতা করতে হবে।

মাথায় নিতে হবে, অন্তরে ধারণ করতে হবে যে, বছরজুড়ে পিতা-মাতা আমাদের জন্য কতই না কষ্ট করেন! তাই এখনই সুযোগ, এখন থেকেই পিতামাতাকে কাজে সহযোগিতা করে, তাদের কষ্টের উপশম করতে হবে, তাদের অন্তত একটু শান্তিতে থাকতে দিতে হবে। একটু খেয়াল করে দেখতে হবে, কত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পিতা তোমাদের জন্য রোজগার করেন। মা কীভাবে রান্না করে খেতে দেন, ঘর পরিস্কার করেন, জামা-কাপড় পরিস্কার করেন, আসবাবপত্র গুছিয়ে রাখেন। তোমাদের গায়ে যাতে মশা না লাগে, সেজন্য মশার কয়েল জ্বালিয়ে দেন, আ্যারোসল স্প্রে করে দেন, মশারিটাও টাঙিয়ে দেন। পরিবারের সকলের সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখেন। কেউ অসুস্থ হলে সেবা শুশ্রƒষা করেন। যাদের বাড়ি গ্রামে তাদের মা তো আরও বেশি কাজ করেন। রান্নার জন্য কাঠ জোগাড় করেন, উঠোন ঝাঁড় দেন, রান্না ঘর, থাকার ঘর, হাঁস-মুরগির ঘর, গরু-ছাগলের ঘর পরিস্কার করেন। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলকে খেতে দেন, সকালে ঘর থেকে ছেড়ে দেন, সন্ধ্যায় ঘরে উঠান- আরও কত কী! আর যদি ছোট ভাই-বোন থাকে তাদের জন্য কত কষ্ট করতে হয়! বাচ্চাকে গোসল করানো, পোশাক পাল্টানো, পোশাক পরিস্কার করা, খাওয়ে দেওয়া, রাতে ঘুম পড়ানো, ঘুম পড়ানোর সময় গল্প বলা, ইত্যদি ইত্যাদি কত কাজ!! একটু নিজ চোখে দেখ। রাতে অনেক সময় মা ঘুমাতেও পারেন না। দিন-রাত কষ্ট করেন মা-বাবা। আর স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা খোলা থাকলে তো কাজ আরও বেড়ে যায়। এখন যদি তোমরা তাদের একটু সাহায্য না করো, তবে কখন করবে?

তাই এই সময়ে বাড়িতে ছোটছোট ভাইবোনের সাথে ঝগড়াঝাটি করা যাবে না। তাদেরকে নিয়ে ইনডোর খেলাধূলা করতে হবে, বিভিন্ন গল্পের বই পড়িয়ে শুনাতে হবে। বাসায় যদি অসুস্থ দাদা-দাদি, নানা-নানি থাকেন তাদের সেবাযত্ন করতে হবে এবং তাদের কাছে বসে অতীতের গল্প শুনে সময় কাটাতে হবে। ছুটিকালীন সময়ে বাড়ির কাজে পিতামাতাকে সহযোগিতা না করে মাত্রাতিরিক্ত গেম খেলে, ফেসবুক, ইউটিউব, টিভি দেখে অযথা পতিা-মাতার বিরক্তির কারণ হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তোমাদের কারণে যেন পারিবারিক সহিংসতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

তবে মনে রাখতে হবে সন্তানের সদাচরণ পাওয়া পিতা-মাতার অধিকার, মোটেও দয়া নয়। এ ব্যাপারে সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। পৃথিবীতে প্রচলিত সকল ধর্মে পিতা-মাতাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এ আল্লাহ রব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে বলেছেন: ‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে’ [লোক্বমান ১৪]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন: ‘আপনার রব নির্দেশ দিলেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, আর তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভাল করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল’ [বনী ইসরাঈল ২৩- ২৫]

পিতা-মাতার প্রত সন্তানের কর্তব্য পালনে মহানবী (সা:) বলেছেন, -এর বহু মূল্যবাণ উপদেশ বাণী রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন: ‘একদিন একজন লোক রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে হাযির হয়ে আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমার কাছে সবচেয়ে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে লোকটি আবারও প্রশ্ন করলো, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তারপর তোমার পিতা’ [বুখারী হা/৫৯৭১; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯১১]

হিন্দু ধর্মের পিতা-মাতাকে সম্মান করা এবং তাঁদের ভরণপোষণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মনুর মতে ‘‘শত অপরাধে অপরাধী হলেও বৃদ্ধ পিতা-মাতা, সতী স্ত্রী এবং শিশুর ভরণপোষণকে কখনো অগ্রাহ্য করা উচিত নহে।’’হিন্দু আইন মতে, ‘‘একজন হিন্দু কোন সম্পত্তির মালিক হোক বা না হোক তার স্ত্রী, নাবালক পুত্র, অবিবাহিতা কন্যা এবং বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণপোষণ দিতে আইনগতভাবে বাধ্য।’’

মোটকথা করোনাকালে পিতা-মাতার প্রতি বেশি বেশি করে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, সহযোগিতা-সহমর্মিতার হাত প্রশস্ত করতে হবে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, সহযোগিতা-সহমর্মিতার হাত প্রশস্ত করতে হবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রতিও। পারস্পারিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, সহযোগিতা-সহমর্মিতার মাধ্যমে তোমাদের প্রতিটি পরিবার হোক শান্তির নীড়- সেই প্রত্যাশা রইল।

এস এম খায়রুল বাসার
সাংবাদিক, কলাম লেখক ও
অধ্যক্ষ, পল্লীমঙ্গল আদর্শ মহাবিদ্যালয়
ইছামতি, অভয়নগর, যশোর।
[email protected]
০১৭১১-৪৫০১৯৩