বৈরুতে জাহাজভর্তি ভয়াবহ বিস্ফোরকের চালান পৌঁছল যেভাবে

লেবাননের বৈরুত বন্দরের গুদামঘরে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুতে আগুন ধরে ভয়াবহ বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ১৫৭ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

কিন্তু এত বিশাল পরিমাণ ভয়ানক দাহ্য পদার্থ ছয় বছরের ওপর শহর কেন্দ্রের এত কাছে কোন নিরাপদ ব্যবস্থা না নিয়ে এভাবে গুদামঘরে কীভাবে রেখে দেয়া হল তা নিয়ে দেশটির জনগণ ক্ষোভে ফুঁসছে। তারা এটা বিশ্বাস করতে পারছে না।খবর বিবিসির।

যে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে বন্দর নগরীর বিস্তীর্ণ জনপদ, তার উৎসের নাম নিচ্ছে না সরকার।

কিন্তু এটা জানা গেছে, মলডোভিয়ান পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি রোসাস ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে ঠিক ওই পরিমাণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিয়ে বৈরুতে নোঙর করেছিল।

রাশিয়ান মালিকানাধীন জাহাজটি জর্জিয়ার বাটুমি থেকে যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে, এটির গন্তব্য ছিল মোজাম্বিকের বেইরা।

জাহাজটি ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ছিল ছোট গোল টুকরোর আকারে। কৃষিকাজে সারের জন্য এই রাসায়নিক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে জ্বালানি তেলের সঙ্গে মিশিয়ে এটা দিয়ে বিস্ফোরক তৈরি করা যায়, যা খনিতে বিস্ফোরণের কাজে এবং নির্মাণ শিল্পে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগর দিয়ে যাবার সময় রোসাস জাহাজটিতে কিছু কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে এবং জাহাজটি বৈরুত বন্দরে নোঙর করতে বাধ্য হয়।

এই তথ্য এসেছে জাহাজ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনে, যেটি শিপিংঅ্যারেস্টেডডটকম নামে একটি নিউজলেটারে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই প্রতিবেদন লিখেছিলেন জাহাজের কর্মীদের পক্ষের লেবানীজ আইনজীবীরা।

বৈরুত বন্দরের কর্মকর্তারা রোসাস জাহাজটি পরিদর্শন করেন এবং সেটিকে সমুদ্রযাত্রার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন বলে জানাচ্ছেন আইনজীবীরা।

জাহাজের বেশিরভাগ কর্মীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাঠানো হয়নি শুধু জাহাজের রুশ ক্যাপ্টেন বরিস প্রোকোশেফ এবং আরও তিনজনকে, যারা ইউক্রেনের নাগরিক বলা হচ্ছে।

প্রোকোশেফ বৃহস্পতিবার রয়টার্স বার্তা সংস্থাকে বলেন, রোসাসে লিকেজের কিছু সমস্যা হচ্ছিল, কিন্তু জাহাজটির সমুদ্র যাত্রার জন্য কোন সমস্যা ছিল না।

তিনি আরও বলেন, জাহাজটির মালিক জাহাজটিকে বৈরুতে পাঠান সেখান থেকে ভারী যন্ত্রপাতির বাড়তি কিছু মাল তোলার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল দেশটির অর্থনৈতিক অসুবিধার মধ্যে তাদের সহায়তা করা।

কিন্তু জাহাজের কর্মীরা ওইসব ভারী যন্ত্রপাতি নিরাপদে জাহাজে তুলতে পারেননি। এরপর জাহাজের মালিক বন্দরের ভাড়া দিতে ব্যর্থ হন। তখন লেবাননের কর্তৃপক্ষ জাহাজটি সেখানে জব্দ করে সেটি বসিয়ে রাখে বলে তিনি জানান।

আইনজীবীরা বলছেন, মালবাহী জাহাজটি যারা চার্টার বা ভাড়া করেছিলেন এবং জাহাজটি নিয়ে যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, তারা সব পক্ষই জাহাজটি নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পাওনাদারদের দিক থেকেও নানাধরনের আইনি দাবিদাওয়া ছিল।

ইতোমধ্যে, জাহাজের ভেতর তখনও যেসব নাবিক ও কর্মী ছিলেন তাদের রসদ ও খাবার দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল।

আইনজীবীরা বলেছেন, তারা বৈরুতের জরুরিকালীন বিচারকের কাছে আবেদন করেন, যাতে ওই ক্রুদের নিজেদের দেশে ফিরে যাবার অনুমতি দেয়া হয়।

আইনজীবীরা তখন জোর দিয়ে বলেছেন, ওই জাহাজে যে রাসায়নিক রয়েছে, তা খুবই ‘বিপজ্জনক’ প্রকৃতির এবং ক্রুরা জাহাজে ঝুঁকির মধ্যে আছেন।

বিচারক শেষ পর্যন্ত ক্রুদের জাহাজ থেকে নামার অনুমতি দেন এবং ২০১৪ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের চালান ১২ নম্বর ওয়্যারহাউসে স্থানান্তরিত করেন।

আইনজীবীরা জানান, ওই রাসায়নিকের চালান হয় নিলামে তোলার অথবা যথাযথভাবে নষ্ট করে ফেলার অপেক্ষায় ছিল।

প্রোকোশেফ বলেন, ওই রাসায়নিক ছিল চরম বিস্ফোরক পদার্থ। সে কারণেই আমরা যখন জাহাজে ছিলাম সেগুলো জাহাজের মধ্যেই রাখা ছিল…ওই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট খুবই উচ্চ ঘনত্বের ছিল।

তিনি আরও বলেছেন, এই বিস্ফোরণে যারা হতাহত হয়েছে তাদের জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষের, দায়ী লেবানিজদের এ জন্য শাস্তি হওয়া উচিত। তারা এই মাল নিয়ে কোনরকম ব্যবস্থা নেয়নি, মোটেও মাথা ঘামায়নি।

বন্দরের জেনারেল ম্যানেজার হাসান কোরায়েতেম এবং লেবাননের শুল্ক বিভাগের মহাপরিচালক, বদরি দাহের, দুজনেই বুধবার বলেন, তারা এবং অন্য কর্মকর্তারা বিচারবিভাগকে সেখানে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত রাখার বিপদ সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেছেন এবং সেখান থেকে এগুলো সরিয়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার বলেছেন।

২০১৪ থেকে ২০১৭-র মধ্যে তারা অন্তত ছয়বার এ ব্যাপারে চিঠি লিখেছেন।