বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ বিশ্বময় ছড়াতে এই পুরস্কার উপযোগী মাধ্যম : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

abdul momen
ফাইল ছবি

জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ‘ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ইন দ্য ফিল্ড অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তনের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, গত ১১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ইউনেসকো নির্বাহী পরিষদের শরৎকালীন ২১০তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই প্রথম জাতিসংঘের কোনো অঙ্গসংস্থা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন করল। ইউনেসকো শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি প্রভৃতিসহ স্বীয় অধিক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গনে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন করে থাকে। ইউনেসকো অধিক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিমান ব্যক্তি তথা প্রতিষ্ঠানের নামে ২৩টি ইউনেসকো আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তিত রয়েছে। এই প্রথম বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের কোনো প্রথিতযশা সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির নামে ইউনেসকো একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন করল।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্যে বলেন, ‘সংস্কৃতি’ ইউনেসকোর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিক্ষেত্র। সমসাময়িককালে বহুল আলোচিত ও চর্চিত বিষয় ‘সৃজনশীল অর্থনীতি’ অঙ্গনে এ আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তিত হয়েছে। এ পুরস্কার সৃজনশীল অর্থনীতিতে যুবসমাজের উন্নয়নে সংস্কৃতিকর্মী, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কর্তৃক গৃহীত ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেবে। সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘ইউনেসকো বঙ্গবন্ধু’ পুরস্কার হবে সংস্থার প্রবর্তিত প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

‘সৃজনশীল শিল্প’-এর ভিত্তি হলো সাহিত্য, সংগীত, হস্তশিল্প, চিত্রকলা, চলচ্চিত্রসহ সৃষ্টিশীলতার নানা মাধ্যম। ইউনেসকো প্রায় এক যুগ ধরে এ বিষয়ে কাজ করে আসছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব-অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক যে প্রভাব পড়েছে, তা সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বিশ্বময় পরিলক্ষিত হয়েছে । করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে গৃহীত নানা বিধি-নিষেধমূলক ব্যবস্থার কারণে শিল্পীসমাজ এবং সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে। কভিড-১৯ মহামারির আগমনের আগে বিশ্ব-অর্থনীতিতে সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল শিল্প খাতের অবদান ছিল বার্ষিক ২.২৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব-অর্থনীতির এই ক্ষেত্র সারা বিশ্বে ৩০ মিলিয়নেরও অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, যার ৪৫% নারী।

বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন দূরদর্শী চিন্তক ছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ, বাকস্বাধীনতার বিকাশে তাঁর সংগ্রাম, স্বাধীনতার পর বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। প্রসংগত উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সৃষ্টির পরপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সংস্কৃতির প্রতি মমত্ববোধ, মাতৃভাষার প্রতি আবেগ সর্বোপরি তাঁর জীবনাদর্শ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে তাঁর নামে একটি পুরস্কার প্রবর্তনের কথা আমরা চিন্তা করি। সংস্কৃতিক্ষেত্রে জাতিসংঘের একমাত্র বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেসকো। ১৯৩ সদস্যবিশিষ্ট ইউনেসকোর মূলনীতি শান্তি ও সম্প্রীতি তৈরিতে সংস্কৃতি শক্তিশালী উপাদান, যা বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনের আন্তর্জাতিকীকরণ ও তা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি ইউনেসকো আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন সবচেয়ে উপযোগী মাধ্যম হবে বলে আমরা মনে করেছি।

এ প্রেক্ষাপটে সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রবর্তনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় অনুমোদনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। গত আগস্ট ২০১৯-এ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় অনুমোদন গ্রহণের পর প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেসকোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে ইউনেসকো মহাপরিচালক বরাবর আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আমরা প্রেরণ করি। ইউনেসকোর অধিক্ষেত্র যেমন শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাকস্বাধীনতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও বাংলাদেশ সরকারের ইউনেসকোর প্রতি অঙ্গীকারের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর নামে পুরস্কার প্রবর্তনে সম্মতি প্রদান করে। ইউনেসকো সচিবালয় গত ২-১১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিত ৫৮ সদস্যবিশিষ্ট ইউনেসকো নির্বাহী পরিষদের ২১০তম অধিবেশনের প্রথম পর্বে এ প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য ইউনেসকো সচিবালয় উত্থাপন করে। ১১ ডিসেম্বর নির্বাহী পরিষদের প্লেনারি সেশনে সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়।

আমরা মনে করি, ইউনেসকোর মতো জাতিসংঘের একটি অঙ্গসংস্থা কর্তৃক প্রবর্তিত এ পুরস্কার বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করবে, বিশ্বময় সংস্কৃতিকর্মীদের সৃজনশীল অর্থনীতির বিকাশে অনুপ্রেরণা জোগাবে। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু যে এক ও অভিন্ন তা পুরস্কারের শিরোনামে প্রস্ফুটিত হয়েছে। এ পুরস্কার বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং ও ইমেজ বিল্ডিংয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি।

প্রতি দুই বছর অন্তর এ পুরস্কার প্রদান করা হবে, যার অর্থমান ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। এ পুরস্কারটি প্রথমবারের মতো আগামী ২০২১ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য ইউনেসকোর ৪১তম সাধারণ সভা চলাকালে প্রদান করা হবে। এখানে প্রণিধানযোগ্য, জাতিসংঘ ২০২১ সালকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সে বিবেচনায় পুরস্কারটি প্রবর্তন সময়োচিত বলে ইউনেসকো মনে করে। ইউনেসকো তাদের কর্মকাণ্ডে নারী-পুরুষ সমতা এবং যুব উন্নয়নকে নীতিগতভাবে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সেদিক থেকেও এ পুরস্কার ইউনেসকো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে সমাজের অনগ্রসর নারী, অভিবাসী ও প্রবাসী জনগোষ্ঠীর সৃজনশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, গত বছর ইউনেসকোর ৪০তম সাধারণ সভায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ইউনেসকোর ‘শতবার্ষিকী কর্মসূচি তালিকা’য় অন্তর্ভুক্ত করে। মুজিববর্ষে এ পুরস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে ইউনেসকো সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হলো। প্রসংগত উল্লেখ্য, ইউনেস্কো ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করে। এর আগে ১৯৯৯ সালে, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমেও ইউনেসকো বাংলাদেশকে সম্মানিত করে। এ ছাড়া ষাটগম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এবং সুন্দরবনকে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে এবং বাউলগান, জামদানি, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও শীতল পাটি বিশ্ব অপরিমেয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে সুপরিচিত করেছে। আমরা ইউনেসকোর নির্বাহী পরিষদের সব সদস্য রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানাই, ইউনেসকো মহাপরিচালক মাদাম অড্রে অ্যাজুলেসহ এ কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের সার্বিক সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।