আজ কমরেড মণি সিংহের ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী

আজ (৩১ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি আজীবন বিপ্লবী কমরেড মণি সিংহের ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক, টংক আন্দোলনের মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন।

১৯৯০ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কমরেড মণি সিংহের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সিপিবিসহ বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ (৩১ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৭ টায় পোস্তাগোলা শশ্মানঘাটে কমরেড মণি সিংহের স্মৃতিস্তম্ভে এবং সকালে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কমরেড মণি সিংহের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়া কমরেড মণি সিংহ স্মরণে আজ (৩১ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টায় সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম এক বিবৃতিতে কমরেড মণি সিংহের ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, আজীবন ত্যাগের মধ্য দিয়ে কমরেড মণি সিংহ এ দেশে আদর্শিক রাজনীতির যে বীজ বপন করেছিলেন, তার ভিত্তিতে শোষণমুক্তির সংগ্রাম অগ্রসর করতে হবে। কমরেড মণি সিংহের স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশের বর্তমান সংকট কাটাতে রাজনীতির আদর্শবাদী ধারাকে অগ্রসর করতে হবে। কমরেড মণি সিংহের আদর্শকে শক্তিশালী করা ছাড়া মানুষের মুক্তি ঘটবে না।

কমরেড মণি সিংহের সংক্ষিপ্ত জীবনী
কমরেড মণি সিংহ ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কালী কুমার সিংহের মৃত্যু হলে, মা সরলা দেবী ৭ বছরের মণি সিংহকে নিয়ে ময়মনসিংহের (বর্তমানে নেত্রকোনা) সুসং দুর্গাপুরে চলে আসেন। এখানে সরলা দেবী তার ভাইদের জমিদারির অংশীদার হয়ে বসবাস শুরু করেন।

স্কুলের শিক্ষা গ্রহণ করার সময় মণি সিংহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দিয়ে ক্রমেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে স্থান করে নেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের বিপুল গণজাগরণ তরুণ মণি সিংহের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর মনে সংশয় দেখা দেয়। এ সময় তিনি শ্রমিক আন্দোলন ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ কমরেড মণি সিংহ ১৯২৫ সালে প্রখ্যাত বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে আলোচনার পর মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শরূপে গ্রহণ করেন।

কমরেড মণি সিংহ ১৯২৮ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে উৎসর্গ করেন। এ সময় তিনি কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকেন। ১৯৩০ সালের ৯ মে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলেও নিজ গ্রাম সুসং দুর্গাপুরে তাঁকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এ সময় কৃষক-ক্ষেতমজুরদের পক্ষ নিলে নিজ মামাদের জমিদার পরিবারের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়। পাটের ন্যায্য মূল্য দাবি করে কৃষকদের পক্ষে ভাষণ দিলে তাঁর দেড় বছরের জেল হয়।

১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এলে পার্টির সদস্য বলে তাঁকে জানানো হয়। এরপর দুর্গাপুরে মায়ের সাথে দেখা করে কলকাতার শ্রমিক আন্দোলনে ফিরে যেতে চাইলেও, এলাকার মুসলমান কৃষক ও গারো, হাজংসহ আদিবাসী মণি সিংহকে ‘টংক প্রথা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। এরপর মণি সিংহ সর্বতোভাবে টংক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন এবং কালক্রমে তিনি এ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৪১ সালে মণি সিংহকে আবার গ্রেপ্তার করে ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে তিনি পরিস্থিতি বুঝে আত্মগোপনে চলে যান।

১৯৪৪ সালে মণি সিংহ সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মণি সিংহ ছিলেন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে কমরেড মণি সিংহকে অসংখ্যবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ণ গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজের আদর্শকে যারা সামনে নিয়ে এসেছেন মণি সিংহ তাদের একজন। আর একাজটি করতে গিয়ে তাঁর ওপর নেমে আসে পাকিস্তান সরকারের দমন-নির্যাতন ও গ্রেপ্তাারি পরোয়ানা। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে প্রায় ২০ বছর তিনি আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি ছিল এবং আইয়ুব সরকার তাঁকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।

১৯৫১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে তিনি আত্মগোপন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে পুনরায় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৬৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে (যে সম্মেলনকে পার্টির প্রথম কংগ্রেস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল) তিনি জেলে থাকাকালীন সময় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সাথে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এ বছর ২৫ মার্চ পুনরায় সামরিক আইন জারি হলে তিনি জুলাই মাসে আবার গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও, ইয়াহিয়া সরকার কমরেড মণি সিংহকে মুক্তি দেয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দীরা রাজশাহীর জেল ভেঙ্গে তাঁকে মুক্ত করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন-সাহায্য-সহযোগিতা আদায়ে কমরেড মণি সিংহের অবদান ছিল অবিসংবাদিত। তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়।

স্বাধীনতার পর কমরেড মণি সিংহ পূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সোচ্চার হন। ’৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ’৮০ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কংগ্রেসের মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার বেআইনি ঘোষিত হয়। জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন চলাকালে ’৭৭ সালে মাঝামাঝিতে ৭৭ বছর বয়সী মণি সিংহ আবার গ্রেপ্তার হন। জিয়ার শাসনামলে তাঁকে ৬ মাস কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়।

কিংবদন্তী এই বিপ্লবী সেনা ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁর দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটে। জাতীয় জীবনে অসাধারণ অবদান ও অনন্য কীর্তির জন্য তিনি ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত হন।