দেশের ইতিহাসে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার রেকর্ড

দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ আইনি নির্দেশনা পেয়ে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের রেকর্ড গড়েছেন করদাতারা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ নিয়েছেন ৭ হাজার ৬৫০ জন করদাতা। এতে ৯৬২ কোটি ৬০ লাখ টাকা কর পেয়েছে এনবিআর। যা অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের ইতিহাসে রেকর্ড হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ) হাফিজ আহমেদ মুর্শেদ বলেন, ‘দেশের ইতিহাসে কোনো একক অর্থবছরে এত অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের রেকর্ড নেই। আশা করছি অর্থবছর শেষে এ আয় প্রদর্শনের হার আরো অনেক বাড়বে।’

এনবিআর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস বা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দাখিলের তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে এনবিআর বলেছে, করদাতাদের রিটার্ন বেড়েছে ৯ শতাংশ। আর অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের যে বিশেষ সুযোগ দিয়েছে, তাতে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন করদাতারা। ফলে আয়কর অধ্যাদেশের ১৯-এর এ ধারা অনুযায়ী, ২০৫ জন করদাতা প্রায় ২২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা কর পরিশোধ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত সিকিউরিটিজে এ বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া ১৯-এর এ ধারা অনুযায়ী, ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা প্রায় ৯৩৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করেছেন। ফলে দেশের ফরমাল ইকোনমি বা আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্রবেশ করেছে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কর জিডিপির হার বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছে এনবিআর। করদাতাদের জন্য আয়কর অধ্যাদেশের ১৯-এর এ এবং ১৯-এর এ ধারার মাধ্যমে কর পরিশোধের সুযোগ ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

প্রসঙ্গত, দেশে এ পর্যন্ত ১৭ বার অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারায় আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রদর্শিত হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ নিয়েছিল। তখন ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা প্রদর্শিত হয়। দেশে প্রথম এ সুবিধা দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালে সামরিক আইনের আওতায়।

অন্যদিকে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে থাকা আইনি নির্দেশনা অনুযায়ী করদাতাদের অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে জমি, ফ্ল্যাট, বিল্ডিং ও অ্যাপার্টমেন্ট, ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, শেয়ারবাজার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজে। এ সুবিধা নিতে ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। নেই কোনো জরিমানা।

অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ প্রশ্নে বাজেটে আরো বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে করদাতার রিটার্ন দাখিলে অজ্ঞতার কারণে তাদের কিছু অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এ অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নের এ ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ প্রদান এবং অর্থনীতির স্রোতে অর্থপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশের আয়কর প্রণোদনা-সংক্রান্ত দুটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ওই দুটি ধারার প্রথমটিতে বলা হয়, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, নতুন অর্থবছরের মধ্যে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।

আর দ্বিতীয় ধারাটিতে বলা হয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম চালিকাশক্তি পুঁজিবাজার। একে গতিশীল করার লক্ষ্যে তিন বছর লক-ইনসহ কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে নতুন অর্থবছরের মধ্যে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা ১০ শতাংশ করহারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। বাজেটে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি বন্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে বলা হয়, আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে আন্ডারইনভয়েসিং, ওভারইনভয়েসিং, ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির বিষয়ে সরকারের অবস্থান কঠোর। এ প্রবণতা রোধকল্পে বিদ্যমান অন্য সব বিধানের পাশাপাশি আয়কর অধ্যাদেশে নতুন একটি ধারা প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, যে পরিমাণ অর্থ আন্ডারইনভয়েসিং ও ওভারইনভয়েসিং করে পাচার হয়েছে এবং যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে তার ওপর ৫০ শতাংশ হারে কর আরোপিত হবে। আন্ডারইনভয়েসিং ও ওভারইনভয়েসিং এবং ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি রোধে এ বিধান অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে।

এনবিআর আরো বলেছে, রাষ্ট্রের রাজস্ব ভাণ্ডারকে শক্তিশালী ও সুসংহত করার লক্ষ্যে সরকারের রাজনৈতিক নির্দেশনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে করদাতাদের সঙ্গে আলোচনা ও অংশীদারির ভিত্তিতে সবার সহযোগিতায় চলতি অর্থবছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে সরকার। এই সময়ে ২৪ লাখ ৯ হাজার ৩৫৭ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। আয়কর সংগৃহীত হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ হাজার ৫৪৫ দশমিক ৯ কোটি টাকা বেশি। এ অর্থবছরের আয়করে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর মধ্যেও স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল ও আয়কর প্রদান করায় করদাতাদের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।