টিকা আনার প্রক্রিয়া অন্য উৎস থেকেও

covid 19 vaccine

শুধু ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদন করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ টিকাই নয়, অন্য উৎস থেকেও দেশে দ্রুত টিকা আনার তৎপরতা চলছে। সেরামের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার আগেই কোভ্যাক্স থেকে টিকা আনার জন্য সরকার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। চলতি বছরের মধ্যেই সেরাম ও কোভ্যাক্সের উৎস থেকে করোনার টিকা এনে ৪০ শতাংশ মানুষকে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।

ভারতের চাহিদা মেটানোর আগে অন্য দেশকে বাণিজ্যিকভাবে টিকা না দেওয়ার বিষয়ে সেরামের একটি বক্তব্য নিয়ে সোমবার বেশ হুলুস্থুল পড়ে যায়। যদিও পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো এবং সেরামের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, সময়মতোই টিকা পাবে বাংলাদেশ। তবে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর আবারও নতুন উৎস থেকেও টিকা আনার বিষয়টি বড় হয়ে সামনে এসেছে। দেশের সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা সরব হয়ে উঠেছেন নতুন সোর্স বা টিকা আনার উৎস নিয়ে। সরকারও এ ক্ষেত্রে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেরাম ও কোভ্যাক্সের বাইরে চীনের একাধিক কম্পানির টিকা আমদানি, দেশে উৎপাদন ও ট্রায়ালের বিষয়ে ভেতরে ভেতরে আগে থেকেই কাজ এগিয়ে চলছে, যা দুই দিন ধরে নতুন গতি পেতে শুরু করেছে। এ ছাড়া রাশিয়ার টিকার বিষয়েও নাড়াচাড়া পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সরাসরি সরকারিভাবে না হলেও বেসরকারি উদ্যোগের ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন টিকা নিয়েও কিছুটা সক্রিয় হয়েছেন সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পাশাপাশি কোভ্যাক্স থেকে পূর্বনির্ধারিত টিকা পাওয়া নিয়ে যাতে নতুন কোনো জটিলতায় আটকা পড়তে না হয়, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের মধ্যে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের জন্য শুধু সেরাম ও কোভ্যাক্সের উৎস থেকে আনা টিকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা রয়েছে, যার মধ্যে সেরাম থেকে আসবে ৯ শতাংশ এবং কোভ্যাক্স থেকে আসবে ৩১ শতাংশ মানুষের টিকা। কোভ্যাক্সের টিকা আসবে দুই ধাপে। প্রথম ধাপের ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা আসার কথা রয়েছে ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে এবং বাকিটা ডিসেম্বরের মধ্যে।

গত সোমবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্যসচিব মো. আব্দুল মান্নানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু যে একটি সোর্সের ওপর নির্ভর করে আছি, তা ঠিক নয়। কোভ্যাক্স থেকেও আমরা টিকা পাচ্ছি; হয়তো কিছুটা দেরি হবে। এ ছাড়া আমরা শুরু থেকে আরো বিভিন্ন কম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম। এখনো সেই যোগাযোগ অব্যাহত আছে। এ ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি আমরা বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও আহ্বান জানিয়েছি এগিয়ে আসার জন্য, কিন্তু খুব একটা যে কেউ আসছে, তেমন নয়।’

সচিব বলেন, ‘যেহেতু ট্রায়াল অনেক সময়ের ও জটিলতার ব্যাপার, তাই আমরা এখন ট্রায়ালের পরিবর্তে বরং আমদানি ও উৎপাদনের দিকে বেশি নজর রাখছি।’

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খোরশেদ আলম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত চীনের একাধিক কম্পানি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা ট্রায়ালও করতে চায়। তাদের আবেদন পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে। হয়তো দ্রুত সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। এর বাইরে রাশিয়ার বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে কিছু যোগাযোগ চলছে বলে আমি শুনেছি, কিন্তু আমি নিশ্চিত নই।’

অন্যদিকে কভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই সরকারকে তাগাদা দিয়ে আসছি শুধু একটি সোর্সের ওপর যেন নির্ভর করা না হয়। আরো বিভিন্ন টিকার ব্যাপারে যেন সরকার সক্রিয় থাকে। কারণ কোনো কারণে কোনো একটি প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে যেন অন্যটি দিয়ে সামাল দেওয়া যায়, কিন্তু তেমন উদ্যোগ এখনো দেখছি না।’

ওই কমিটির আরেক সিনিয়র সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলামও প্রায় একই সুরে বললেন, ‘আমরা কয়েক মাস ধরে বলে এলেও সরকার একটির বাইরে আর কোনো উৎস জোগাড় করতে পারল না। তাই চীনের সিনোভ্যাক নিয়ে অযথা সময়ক্ষেপণ করে ওই গ্রুপকে তাড়িয়ে দিল। আবার নিজেদের দেশের একটি কম্পানি এগিয়ে এসেছিল, তাদেরও সহায়তার কোনো পদক্ষেপ নেই। এমনভাবে চললে তো মুশকিলে পড়তে হবে।’

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকাদান কর্মসূচি) ডা. শামসুল হক বলেন, ‘সেরামের বাইরে আমরা এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গঠিত কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার আগাম সব বুকিংপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। দফায় দফায় তাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক ও যোগাযোগ হচ্ছে। কোভ্যাক্সের নীতিমালা অনুসারে আমরা প্রথম ধাপে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের টিকা কোভ্যাক্স থেকে পাব। সেই হিসাবে আমরা তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য টিকা পাব। দুই ডোজের টিকা হলে মোট টিকা লাগবে ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ।’

তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে কোভ্যাক্সের নির্ধারিত দাম অনুসারে প্রতি ডোজ টিকার জন্য দিতে হবে দুই ডলার করে। দুই ডোজের জন্য জনপ্রতি ধরা হয়েছে চার ডলার করে। এর সঙ্গে পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিজনকে টিকা প্রয়োগের জন্য ধরা হয়েছে আরো আড়াই ডলার করে। সব মিলিয়ে দেশে কোভ্যাক্স থেকে টিকা আনতে ও প্রয়োগ করতে মাথাপিছু খরচ ধরা হয়েছে প্রাথমিকভাবে সাড়ে ছয় ডলার করে। অর্থাৎ কোভ্যাক্সের আওতায় বাংলাদেশ যদি তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করে তবে এর পেছনে ব্যয় হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।

ডা. শামসুল বলেন, ‘কোভ্যাক্স থেকে সর্বশেষ জানানো তথ্য অনুসারে, ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে প্রথম কোভ্যাক্সের টিকা বাংলাদেশে আসবে। আর সে অনুসারে চলতি ২০২১ সালের মধ্যে সেরাম ও কোভ্যাক্স থেকেই দেশের মোট ৪০ শতাংশ মানুষের করোনার টিকা দেশে আনা ও প্রয়োগ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এরপর বাকিদের জন্য কোভ্যাক্স থেকে আরো টিকা পাওয়ার ব্যাপারেও কথাবার্তা চলছে। চলতি বছরে টিকা জোগাড় করার জন্য আমাদের হাতে এখন ৫০০ কোটি ডলারের জোগান রয়েছে। এর মধ্যে আজই (গতকাল) আমরা সেরামকে ৫০৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি।’