‘আমরা জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলাম’ : ফখরুল

mirza fokrul
ফাইল ছবি

সরকারের উদাসীনতা, অগ্রাধিকার নির্ধারণে ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা, রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের অপকৌশল হিসেবে করোনা সংক্রমণের তথ্য গোপন ও সীমাহীন ব্যর্থতা আজ পুরো দেশকে এক বিপদ সঙ্কুল পথে নিয়ে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, আসুন আমরা জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ সংকট মোকাবেলায় উদ্যোগী হই।

আজ শুক্রবার বিএনপি চেয়ারপার্সনের অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানান বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনা সনাক্ত এবং মহামারী আকারে সংক্রমণের পর সারা বিশ্বের জনবান্ধব রাষ্ট্রগুলো যখন সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে- বাংলাদেশের সরকার তখন স্বভাবসুলভ বলতে শুরু করে, “আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী”। “যে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সে দেশে করোনা কিছইু করতে পারবে না।” এসব উন্মাদীয় বক্তব্য দিয়ে তারা জনগণের সাথে প্রতারণা শুরু করে এবং করোনা প্রতিরোধে সামান্যতম উদ্যোগ গ্রহণ না করে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে বিভোর থাকে।

গত বছর দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর সময়ের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে যখন বিমান চলাচল সীমিত এবং যাত্রী প্রবেশে কঠোর কড়াকড়ি আরোপ করলো, বাংলাদেশ তখনও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ও নির্বিকার থাকলো। করোনাক্রান্ত দেশ চীন, ইতালি, স্পেন মধ্যপাচ্য থেকে প্রচুর প্রবাসী কর্মহীন হয়ে পড়ায় কিংবা নাড়ীর টানে দেশে ফিরে আসে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে হৈচৈ শুরু হলে তারা বললো, করোনা প্রতিরোধে বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত থার্মাল স্ক্যানার বসানো হয়েছে। অথচ দেখা গেলো ১টি ছাড়া সবগুলো থার্মাল স্ক্যানারই ছিল নষ্ট। অনেকটা যথাযথ করোনা পরীক্ষা ছাড়াই বিদেশ থেকে বিশেষ করে করোনা সংক্রমণ দেশ থেকে আসা প্রায় ৬.৫ লক্ষ প্রবাসী দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এটাই হল সরকারের করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক ব্যর্থতা। ঠিক একই ভাবে, দেশে ৫ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে করোনার নূতন স্ট্রেইন ধরা পড়লেও তা গোপন রাখা হয়। সরকার তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপন করে এবং সংক্রমণের বাস্তবচিত্র গোপন করে।

তিনি বলেন, সরকার জনস্বার্থ উপেক্ষা করে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমগ্র প্রশাসনকে ব্যস্ত করে রাখে। এতে করে করোনা সংক্রমণ দমন ও নিয়ন্ত্রণে বিলম্বের কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

সরকারের সমন্বয়হীনতা ও কৌশলগত পরিকল্পনার অভাব রয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, শুরু থেকেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় সরকারের অসহায়ত্ব ও চরম সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান। জাতীয় পরামর্শক কমিটি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নীতি নির্ধারকদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না। পরামর্শক কমিটির সিদ্ধান্ত মানা হয়নি। সরকারী সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানেন না। লকডাউন না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা হয়। পোশাক শিল্পের কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় অবগত নয়। কোভিড-নন কোভিড হাসপাতাল নির্ধারণ, চিকিৎসকগণ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম ছিল চরম হতাশাব্যঞ্জক।

তিনি বলেন, চীনা বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ডা: ওয়েন বীও এর মতে, “বাংলাদেশে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো কাজ হয়েছে”। এভাবে ভাইরাস মোকাবেলা করা সত্যিই কঠিন। কার্যকর লকডাউন, দ্রুত বেশি সংখ্যক পরীক্ষা, কন্টাক্ট ট্রেসিং ও চিকিৎসার পরিধি বাড়ানোর মাধ্যমে পরিক্ষিত উত্তরণ সম্ভব ছিলো- কিন্তু তা করা হয়নি। আমরা তখনও এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানালেও সরকারের একগুঁয়েমির কারণে তা সম্ভব হয়নি, ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

হাসপাতালের প্রস্তুতি না থাকা প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেয়া হলেও সরকারের পক্ষ থেকে হাসপাতালগুলোকে করোনা চিকিৎসার উপযোগী করা হয়নি। তাছাড়া হাসপাতালকে কোভিড-নন কোভিড চিহ্নিত করে আলাদা না করায় দেশে স্বাস্থ্য সেবায় চরম নৈরাজ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। করোনা রোগীরা যেমন হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেনি, তেমনি সাধারণ স্বাস্থ্য সেবা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। ঘটেনি।

তিনি বলেন, দেশের অন্তত: ৪৬টি জেলায় যথাযথ চিকিৎসার সুবিধা সম্বলিত ওঈট/হাইফ্লো অক্সিজেন/ ভেন্টিলেটর ব্যবস্থা এক বছরেও গড়ে তোলা হয়নি। দেশের ৭৯ টি সরকারি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির কার্যক্রম হাতে নেয়া হলেও সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা ও উদাসীনতায় ৫০% অগ্রগতিও হয়নি এক বছরে।

করোনায় টেস্ট নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, কতিপয় বেসরকারী হাসপাতালের করোনা বাণিজ্যের সুযোগ করে দেয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। করোনা পরীক্ষা ও আক্রান্তদের চিকিৎসায় এ বাণিজ্য চরমে পৌছে। বেসরকারী হাসপাতালের করোনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। এছাড়া পরীক্ষা ছাড়া রিপোর্ট প্রদান করে, রিজেন্ট-জেকেজিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসা সেবায় ভূতুড়ে বিলের বিষয়গুলোতো গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। এক ঘণ্টার অক্সিজেন বিল ৮০ হাজার টাকা, চিকিৎসা ব্যয় লক্ষ লক্ষ টাকা এগুলো সংবাদ মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি।

টেস্ট জালিয়াতি এবং সরকারের করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থতা অদক্ষতা দেশ-বিদেশে চরম আস্থার সংকট তৈরী করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, করোনা টেস্ট জালিয়াতি বিদেশে কর্মরত ও অবস্থানরত আমাদের প্রবাসীরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিলো। জাল সনদ নিয়ে বিদেশ গিয়ে বিপাকে পড়েছে শত শত ইতালি প্রবাসী। সেখানকার পত্রিকায় এমন প্রতিবেদন এসেছে যে ইতালির প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি বাংলাদেশিকে করোনা বোমা আখ্যায়িত করেছিলেন।

করোনার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত কর্মহীন মানুষের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রেরিত ত্রাণ সামগ্রী সরকারি দলের স্থানীয় চেয়ারম্যান/ মেম্বার/ নেতারা ব্যাপকভাবে লুট করেছে। চাল-ডাল-তেল চুরির শত শত ঘটনা প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা সরকারকে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার দাবী জানিয়েছিলাম, সরকার শুধু মালিক পক্ষকে প্রণোদনা দিয়েছে কিন্তু শ্রমিকদের জন্য কোন সহায়তা ছিলনা।

সরকারের নিষেধাজ্ঞা/লকডাউন পলিসি সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দোকান কর্মচারী ও পরিবহন শ্রমিকদের খাবার/আর্থিক সহায়তা না দিয়ে বন্ধের ঘোষণা চরম অমানবিকতার পরিচয় বহন করছে।

তিনি বলেন, সরকার করোনার প্রথম ঢেউয়ে সারাবিশ্বের কার্যকর লকডাউন পদ্ধতি অনুসরণ না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এতে করে শহরের মানুষের ঘরমুখী ঢেউ পরিলক্ষিত হয়, কিছুদিন পরই গার্মেন্টস খুলে দিয়ে সেই গ্রামে চলে যাওয়া শ্রমিকদের ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। ২য় ঢেউয়ে সরকার আবার হঠাৎ করে লকডাউন/নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতেও জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে হাটবাজার-রাস্তায় হুমড়ী খেয়ে পড়ে। এতে করে দেখা যাচ্ছে সরকার কোন বারই বিষয়টি সুপরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নেয়নি। এতে করে ব্যবসায়ী/শ্রমিক সহ নিম্ন আয়ের মানুষগণ হতাশাগ্রস্থ হয়ে জীবিকার তাড়নায় মাঠে নেমে আসে।

করোনা টিকা ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত দেশে টিকা এসেছে ১ কোটি ২ লাখ ডোজ। তার মধ্যে ৩২ লাখ উপহার। ৭০ লাখ কিনেছে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে। ৩ কোটি টিকা কেনার কথা। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিমাসে ৫০ লাখ টিকা পাওয়ার কথা। জানুয়ারিতে ৫০ লাখ, ফেব্রু য়ারিতে ২০ লাখ এসেছে। মার্চে কোন টিকা আসে নাই, কবে পরের চালান আসবে কেউ জানেন না। এ পর্যন্ত প্রায় ৫৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের করোনা মহামারী দমনে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার বিকল্প নাই। দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা গেলে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে একটি উৎস থেকে টিকা সংগ্রহে আবদ্ধ না থেকে GAVI- এর সহায়তায় অন্য কোম্পানীর টিকা যেমন জনসন, মর্ডানা, ফাইজার ইত্যাদি সংগ্রহের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি বলেন, জাতির এই চরম দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমরা জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলাম। কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত আরএমজি সেক্টরে কয়েক হাজার গামেন্টস বন্ধ হয়েছে। ৪০ লক্ষ শ্রমিকের জীবন জীবিকা আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই দশ লক্ষ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে। অর্থের অভাবে ঢাকা ছাড়ছে শত শত পরিবার। তাই সরকারের প্রতি আমাদের আবারও আহ্বান আসুন আমরা জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ সংকট মোকাবেলায় উদ্যোগী হই।