গণতন্ত্র চর্চার অভাবে মানবাধিকার সংকট

 

বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি শুনলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। বৈঠকে তিনি নিজে কিছু বলেননি, শুনেছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার অভাবের কারণে মানবাধিকার সংকট বিদ্যমান রয়েছে বলে মিশেল ব্যাচেলেটকে জানান মানবাধিকার কর্মীরা। বৈঠক সূত্র এ তথ্য জানায়।

 

‘চ্যাথাম হাউস’ পদ্ধতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীরা। চ্যাথাম হাউস পদ্ধতি অনুযায়ী বৈঠকের তথ্য বাইরে প্রকাশ করা যায় না। ফলে বৈঠকে উপস্থিত এক মানবাধিকার কর্মী নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেন, বৈঠকে ১৫ থেকে ১৬ জন মানবাধিকার কর্মী উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা নিজ নিজ খাতের বিষয়গুলো হাইকমিশনারের সামনে তুলে ধরেন। বৈঠকে একেকজনের জন্য ২ থেকে ৩ মিনিট সময় রাখা হয়েছিল। তবে মিশেল ব্যাচেলেট বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি বিশ্বের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।

 

 

বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশে আইনের বৈষম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা, কার্যক্রম চালানো এনজিওগুলোর কাজে বাধা, আসন্ন নির্বাচন, গণতন্ত্রের অবস্থা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা, প্রতিবন্ধীদের অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, আদিবাসীদের অধিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ (ডিএসএ) বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন বিষয় মিশেল ব্যাচেলেটের কাছে তুলে ধরা হয়।

 

বৈঠকে উপস্থিত ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি সমকালকে বলেন, জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো বিষয়গুলো বৈঠকে আমি তুলে ধরেছি। একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন ও পক্ষপাতমুক্ত তদন্ত দল যেন সরকারকে গঠন করতে বলেন, সে কথাটাই মিশেল ব্যাচেলেটকে বলেছি। এই তদন্ত দলটি যেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের পদ্ধতি বা মেকানিজমের মধ্যে থেকে করা হয়, যাতে সরকারের কাছ থেকে এ বিষয়ে একটি ফলাফল পাওয়া যায়। যারা ‘গোপন আটক’ অবস্থায় রয়েছে, তাদের অবস্থা যাতে আমাদের জানানো হয়। সরকার তো বরাবরই জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে যাচ্ছে।

 

মিশেল ব্যাচেলেট বৈঠকে কী বলেছেন- জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত আরেক মানবাধিকার কর্মী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ব্যাচেলেট বলেছেন, তিনি সরাসরি বাংলাদেশকে কোনো কিছুর পরিবর্তনের জন্য চাপ দিতে পারবেন না। কিন্তু সরকার যাতে পরিস্থিতির উন্নয়ন করে, সে বিষয়ে প্রভাব খাটাতে পারেন। তিনি জানিয়েছেন, মানবাধিকার কর্মী হিসেবে তাঁর কাজটি তিনি করছেন।

তিনি বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও বিশ্বের ৮০টির মতো দেশে শাসন ব্যবস্থায় সমস্যা চলছে বলে বৈঠকে জানিয়েছেন মিশেল ব্যাচেলেট। কোথাও বিদ্রোহ হচ্ছে, কোথাও আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো কাজ করছে না। বিশ্বের চলমান মানবাধিকার সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

 

বৈঠকে আগামী নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে কী বলা হয়েছে- জানতে চাইলে আরেক মানবাধিকার কর্মী বলেন, বৈঠকে যারা ছিলেন সবাই মানবাধিকার কর্মী। সবাই একটি জায়গাতেই কথা বলেছেন, গণতন্ত্র চর্চার অভাবে দেশে মানবাধিকার সংকট বিদ্যমান। যিনি পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তিনিও সেখানে প্রভাবমুক্ত হয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাবে। বাংলাদেশে যে আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেগুলো আন্তর্জাতিক সনদ ও মান অনুযায়ী কার্যকর নয়। বিভিন্ন আইনের দ্বারা এনজিওগুলোর কার্যক্রমে এক প্রকার বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যথাযথ না থাকায় আগামী নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে বৈঠকে।

গতকাল ১৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে বাংলাদেশে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন মিশেল ব্যাচেলেট। এরপর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে শ্রদ্ধা জানান তিনি। গতকাল বিকেলে কক্সবাজার গেছেন জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার। আজ ১৬ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন তিনি। সেখানে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ছাড়াও সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।

আগামীকাল ১৭ আগস্ট সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন মিশেল ব্যাচেলেট। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখা ছাড়াও বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করবেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার ও চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাচেলেট।