মাঠ প্রশাসন থেকে ধাক্কা খেল নির্বাচন কমিশন

 

জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে ‘নিরপেক্ষ আচরণের’ বার্তা দিতে মাঠ প্রশাসনকে ঢাকায় ডেকেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তাঁর বক্তব্যে বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। তবে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে ইসির শীর্ষ কর্তাদের প্রথম যাত্রা সুখকর হয়নি।

বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের বক্তব্যের জের ধরে মাঠ প্রশাসনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় উল্টো বার্তা পেয়েছেন সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির কর্তারা। দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই ছিল মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে বর্তমান কমিশনের প্রথম বৈঠক। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে সৃষ্ট আস্থাহীনতার জন্য ডিসি-এসপিদের ওপর সরাসরি দায় চাপাতে গিয়েছিলেন সাবেক এই আমলা। তবে সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে বক্তব্য শেষ না করেই নিজ আসনে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। মাঠ প্রশাসনের এই আচরণে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় তাঁর সহকর্মীরাও, অনুষ্ঠানের বাকি সময়টা কাটিয়েছেন বেশ অস্বস্তিতে। পরবর্তী সময়ে অন্য কমিশনারদের বক্তব্যেও প্রসঙ্গটি সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

 

গত দুই জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেশের রাজনৈতিক, কূটনীতিকমহলসহ সবারই বক্তব্য ছিল ‘মাঠ প্রশাসনের ওপর ইসির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই হবে আগামী নির্বাচনের বড় চ্যালেঞ্জ।’ এ রকম পরিস্থিতিতে গতকাল শনিবারের বৈঠকে ইসির জন্য উল্টো বার্তা বলে মনে করছেন ইসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

সভার শেষ বক্তব্যে সিইসি ডিসি-এসপিদের দলীয় কর্মী-সমর্থক না ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে বৈঠকে নির্বাচনী কাজে নিজেদের আরও বেশি সম্পৃক্ত এবং তাঁদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন ডিসি-এসপিরা। জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে আনারও পরামর্শ এসেছে তাঁদের কাছ থেকে।

 

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর মাঠের খবর জানতে গতকাল ঢাকার আগারগাঁওয়ে সব জেলার ডিসি ও এসপিদের নিয়ে এ বৈঠকের আয়োজন করে ইসি। বৈঠকে জেলা পর্যায়ে প্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড ইসি পর্যবেক্ষণে রাখবে বলেও সতর্ক করেন সিইসি।

সকাল ১০টা থেকে তিন ঘণ্টার এই বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, ইসি সচিবসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কভিড আক্রান্ত হওয়ার কারণে বৈঠকে আইজিপি অংশ নেননি বলে জানা গেছে।

 

সংসদ নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থাকে এসপির ওপরই। তবে শুধুই রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়ে সন্তুষ্ট নন ডিসিরা। নির্বাচনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিজেদের আরও বেশি সম্পৃক্ততার দাবি করেছেন তাঁরা। যদিও ইসি ঘোষিত রোডম্যাপে বলা হয়েছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা যতদূর সম্ভব ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে।

 

বৈঠক সূত্র জানায়, মাঠের পরিস্থিতি ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে এই সভার আয়োজন করা হলেও ডিসি-এসপিদের বক্তব্যজুড়ে ছিল তাঁদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি। কক্সবাজারের ডিসির মাধ্যমে বক্তব্য শুরু হলেও প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন ডিসি ও এসপি বক্তব্য দেন। নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের গাড়ির তেল খরচ ও আপ্যায়ন খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল বেশিরভাগ বক্তার। পাশাপাশি প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগে জেলা প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাবও দেন অনেকেই। ইভিএম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণার বিষয়টিও উঠে আসে মাঠ পর্যায়ের শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্যে। এই বিভ্রান্তি দূর করতে তাঁরা ব্যাপক প্রচার চালানোর পরামর্শ দেন।

 

সূত্র জানায়, বৈঠকে দক্ষিণাঞ্চলের একজন ডিসি বলেন, এই জেলার ৬টি উপজেলা নদীবেষ্টিত। কিন্তু কোস্টগার্ডের সংখ্যা খুবই কম। বিজিবিকে দ্রুত পাঠানো সম্ভব হয় না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেটদেরও সংকট থাকে। এমন চরাঞ্চলসহ পার্বত্য এলাকার ভোটকেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পৃথক পরিকল্পনার পরামর্শ দেন। তিনি ভোটকেন্দ্র কমানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, অতীতে প্রভাব খাটিয়ে অনেক কেন্দ্র করা হয়েছে। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। তাই কেন্দ্র কমিয়ে দিলে সাধারণ ভোটারদের সমস্যা হবে না এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কাজ করা সহজ হবে। একই ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছেন আরও একাধিক জেলার ডিসি ও এসপি।

 

অন্য একটি জেলার ডিসি বলেন, মাঠ প্রশাসনে কাজ করতে গিয়ে এখন তাঁরা নতুন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে যাঁরা তাঁদের ওপর নির্দেশনা দিচ্ছেন তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতি আমলে নিতে পারছেন না। কারণ তাঁরা মাঠ পর্যায়ে আরও ২০ বছর আগের অভিজ্ঞতায় নির্দেশ পাঠান। কিন্তু এই সময়ে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

 

ইসি সূত্র জানায়, যে কোনো নির্বাচনে নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্র্রেটদের জন্য প্রতিদিন সাড়ে ৩ হাজার টাকার তেল খরচ ও আড়াই হাজার টাকা আপ্যায়ন ভাতা দেওয়া হয়ে থাকে। ডিসি-এসপিদের বক্তব্যে ম্যাজিস্ট্র্রেটদের জন্য নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে পৃথক সম্মানী চালুর প্রস্তাব করা হয়।

 

মাঠ প্রশাসন থেকে এসব বক্তব্য আসার পরে কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, বৈঠকে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতটা বক্তব্য এসেছে নির্বাচন প্রসঙ্গে তেমন কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় এমপিদের তরফে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রকাশ্যে ফল পাল্টে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো এমপি ইসি সদস্যদের প্রকাশ্যে গালিও দিচ্ছেন। ইসির পক্ষ থেকে আয়োজিত রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন অংশীজনের সংলাপে ডিসিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ওপরে সৃষ্ট আস্থাহীনতার জন্য তিনি মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দায়ী করেন। এ সময় তিনি মাঠ প্রশাসনের কর্তাদের নখদন্তহীন এবং মন্ত্রী-এমপিদের ছাড়া চলতে পারেন না বলে মন্তব্য করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ম্যাজিস্ট্র্রেটদের বিদ্যমান সুবিধাও তাঁদের হাতে পৌঁছায় না।

 

তাঁর এই বক্তব্যের পরে সভাকক্ষের মধ্যেই একযোগে ডিসি-এসপিরা হইচই শুরু করেন। এ সময় সিইসিসহ অন্য কমিশনারবৃন্দ এবং জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবও মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। এ পর্যায়ে কমিশনার আনিছ বলেন, তাহলে কি আপনারা আমার বক্তব্য শুনতে চান না। তখন সবাই একযোগে ‘না’ বলে উঠলে নিজের বক্তব্য শেষ না করেই বসে পড়েন সর্বশেষ জ্বালানি সচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া এই কমিশনার।

 

নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে সিইসির আহ্বান: সভার শেষ পর্যায়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বৈঠকে বলেন, মাঠ প্রশাসনকে দলনিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে হবে। এমন কাজ করা যাবে না, যাতে জনগণ মনে করে মাঠ প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। আগামী ১৭ অক্টোবর জেলা পরিষদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে প্রচুর অভিযোগ আসছে। শক্তি প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, মনোনয়ন প্রত্যাহারের হুমকিসহ বহু অভিযোগ কমিশনে এসেছে। এসব বিষয় এখন প্রতিহত করতে না পারলে নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে। পরবর্তী নির্বাচনে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

 

মাঠ প্রশাসনের কর্তাদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে। বিষয়টি অনুধাবন করবেন এবং চিন্তায় ধারণ করবেন। তিনি আরও বলেন, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শান্তিপূর্ণ পন্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। উচ্ছৃঙ্খলতা, অসহিষ্ণুতা, সংঘাত, সহিংসতাসহ নানা কারণে স্বাধীন ভোটাধিকার বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নির্বাচন বিতর্কিত হয়। নির্বাচিত সরকারের বৈধতা ও ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

 

সংবাদ সম্মেলনে সিইসি: ইসির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ইসি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। মাঠ প্রশাসনকে দলনিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না।

 

কর্মকর্তাদের সতর্ক করে সিইসি বলেন, নির্বাচনের সময় ইসির অবস্থান থাকবে কঠোর। মাঠ কর্মকর্তাদের কাজও পর্যবেক্ষণ করা হবে। দায়িত্ব পালনে কোনো শৈথিল্য সহ্য করা হবে না। ইসি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন ও ক্ষমতা প্রয়োগে কঠোর অবস্থানে থাকবে। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচন নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে।

 

ইভিএম প্রসঙ্গ নিয়ে সভায় আলোচনা হলেও মাঠ পর্যায়ের কর্তারা এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান সিইসি।

 

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাউকে যেন হয়রানি করা না হয় সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভোটের এখনও এক বছর দুই মাসের বেশি সময় বাকি রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠেয় সব নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে নিজেদের ভূমিকা রাখার নির্দেশনা দেন সিইসি।

 

এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র এবং সেনাবাহিনীরও প্রয়োজন হতে পারে। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্নিষ্টরা ইসির অধীনে থাকবে। ইসির নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকবে। অবাধ্য হলে ইসি তার করণীয় দেখাবে।