প্রয়াত বাবা বিমল কুমার রায় ছিলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুপরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কর্মীও।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে নওগাঁ জেলা ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক এবং আমৃত্যু যিনি ছিলেন নওগাঁর মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
কিন্তু প্রয়াত এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবারও যুগ্ম সচিব হতে পারেননি। বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিলেও বঞ্চিত হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল রায়ের মেধাবী সন্তান উপসচিব অভিজিৎ রায়। বর্তমানে তিনি গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে-পদোন্নতির জন্য ফিট থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন ক্যাডারের ২১তম ব্যাচের আরও ১৫-১৬ কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। বলা হচ্ছে, পূর্বের তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে পুনরায় যাচাই-বাছাই করলে ইতঃপূর্বে পদোন্নতি বঞ্চিত লেফটআউট তালিকা থেকে আরও কয়েকটি নাম যুক্ত হতে পারত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দফায় দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, ‘পূর্বের অসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের এবারও বাদ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং এসএসবি (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) যদি নিরপেক্ষভাবে কাউন্টার অনুসন্ধান করত, তাহলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসত।’ তারা বলেন, ‘মানুষকে তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করলে মহান সৃষ্টিকর্তাও ক্ষমা করবেন না।’
সূত্র জানায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার রায় জীবনবাজি রেখে সম্মুখসমরে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ চলাকালে তার সহযোদ্ধা তৎকালীন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুনকে রাজাকাররা নির্মমভাবে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শহিদ করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু মামুন দেশের জন্য এভাবে জীবন দিয়ে গেলেও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার এবং বিমল রায়ের অবস্থান সম্পর্কে রাজাকারদের কোনো তথ্য দেননি। সহযোদ্ধার এমন আত্মত্যাগের কথা শোনার পর রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমল কুমার রায় আরও বজ কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তিনি এবং তার সঙ্গে থাকা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতার জন্য বীর বিক্রমে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। দেশ স্বাধীনের পর সরকারি চাকরি পাওয়ার সুযোগ ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বন্ধবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘তোর চাকরি করার দরকার নেই। আমার সঙ্গে রাজনীতি কর।’ এরপর তিনি স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে নওগাঁ জেলা ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বাকিটা ছিল গৌরবোজ্জ্বল বর্ণাঢ্য ইতিহাস।
এদিকে রাজনীতির পাশাপাশি লেখাপড়া শেষ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার রায় শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ই তিনি মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল্লাহ আল মামুনের নামে নিজ এলাকায় গড়ে তোলেন গোটগাড়ি শহীদ মামুন সরকারি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ। সেখানে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি পরলোক গমন করেন ২০০৭ সালের ২২ নভেম্বর।
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির জন্য এবার যে ফিট তালিকা প্রস্তুত করা হয় সেখানে সবদিক বিচার-বিশ্লেষণ করে এসএসবির জন্য ২১তম ব্যাচ থেকে ১৪৭ জনের সংক্ষিপ্ত ফিট তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এরমধ্যে নিয়মিত এ ব্যাচ থেকে লিয়েন পোস্টিংসহ সর্বসাকুল্যে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৩২ জন। ফলে এখানে বাদ পড়েছেন ১৫ জন। এদের মধ্যে আলোচ্য অভিজিৎ রায় ছাড়াও যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন-ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন, কালা চাঁদ সিংহ, ড. মোহাম্মদ মাহে আলম, মো. মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, নূর মোহাম্মদ মাসুম, রেল সচিবের পিএস মুহম্মদ মাহবুবুল হক, ডিএম আতিকুর রহমান, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিবের পিএস নেওয়াজ হোসেন চৌধুরী, সাতক্ষীরার সাবেক ডিসি এসএম মোস্তফা কামাল, মো. আশরাফুজ্জামান, মাহমুদুর রহমান ও কংকন চাকমা।
এছাড়া ইকোনমিক ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হওয়া, উপসচিব পদে অপশন দিয়ে আসা আদার্স ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং লেফটআউট তালিকা থেকেও কেউ কেউ পদোন্নতি পাননি। যারা পদোন্নতি প্রত্যাশী ছিলেন। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের অনেকে বলেন, উপসচিব হওয়ার পর বিভাগীয় মামলায় শাস্তি ছাড়া অন্যান্য গোপনীয় প্রতিবেদনের কারণে যাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি-তাদের বিষয়গুলো পুনরায় নিরপেক্ষভাবে যাচাই-বাছাই করা জরুরি। এজন্য তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, এসএসবি যাদের পদোন্নতি দেয়নি তাদের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। যে কারণে এসএসবিতে আলোচনা হলেও তাদের নাম শেষ পর্যন্ত পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়নি। অপর একটি সূত্র জানায়, এসি ল্যান্ড কিংবা মাঠ প্রশাসনে কর্মরত থাকাবস্থায় বিভাগীয় মামলায় যাদের শাস্তি হয়েছে, কিংবা বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, যা তদন্তাধীন। এমন কর্মকর্তাদেরও যুগ্ম সচিব করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে পদোন্নতিবঞ্চিত একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘অনেক সময় অধস্তন কর্মচারীর অপরাধের দায়ও দপ্তর প্রধান হিসাবে কর্মকর্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া বিভাগীয় মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযুক্ত না করলেও জনপ্রশাসন সচিব যদি চূড়ান্ত আদেশ দেওয়ার সময় তিরস্কারের দণ্ড চাপিয়ে দেন, সেটি কী ন্যায়বিচার হবে? ধরে নিলাম ন্যায়বিচার করা হয়েছে। কিন্তু ওই কর্মকর্তাকে যদি যথাসময়ে সিলেকশন গ্রেড ছাড়াও উপসচিব হিসাবেও পদোন্নতি দেওয়া হয়, তাহলে তিনি কেন এখন যুগ্ম সচিব হতে পারবেন না?’
তিনি বলেন, ‘উপসচিব হওয়ার পর কোনো অভিযোগ না থাকলে এবং পদোন্নতি পাওয়ার জন্য সবকিছু ঠিক থাকলে তাকে বঞ্চিত করার হেতু কী। এক মুরগি কতবার জবাই দেওয়া যায়?’