দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে তদবিরে রেলমন্ত্রী

nurul islam sujon
ফাইল ছবি

করোনা প্রতিরোধসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতিতে সংশ্নিষ্টতা এবং রেলের ইঞ্জিন কেনায় অনিয়মের তদন্তে তাঁর নাম এসেছিল। তাঁকে মামলা থেকে বাঁচাতে লোক দেখানো সতর্কও করেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যোগ্যতা শর্ত শিথিল করে সেই কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য বারবার প্রস্তাব দিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়। সবশেষ তাঁর জন্য আধাসরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) পদে ওই কর্মকর্তাকে বসাতেই পদোন্নতির জন্য এত তদবির।
আলোচিত এই কর্মকর্তার নাম মঞ্জুর-উল আলম চৌধুরী। তিনি রেলের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী। অতিরিক্ত মহাপরিচালক রোলিং স্টক (এডিজি-আরএস) চলতি দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁকে তৃতীয় গ্রেড থেকে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার দ্বিতীয় গ্রেডে পদোন্নতি দিতে গত ৯ নভেম্বর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে ডিও দেন রেলমন্ত্রী।

এতে বলা হয়েছে, মঞ্জুর-উল আলম সংস্কৃতিমনা কর্মকর্তা। তাঁর শ্বশুর ডা. আবু সোলায়মান মণ্ডল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী বরেণ্য বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাল্যবন্ধু। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। সোলায়মান মণ্ডল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

যদিও সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ-তদবির নিষিদ্ধ। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর বিধি-২০ এ বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী তাঁর পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে পারবেন না।’ রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেছেন, মন্ত্রণালয় ডিও পাঠায়নি। মন্ত্রীর দপ্তর থেকে দেওয়া হয়ে থাকলে, সে বিষয়ে জানেন না বলে জানিয়েছেন সচিব।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি চাকুরে তদবির করাতে পারবেন না। অন্যদিকে শপথ গ্রহণকারী জনপ্রতিনিধিও সরকারি চাকুরের জন্য ডিও দিতে পারেন না, এতে তার শপথ ভঙ্গ হয়। এই নিয়ম-কানুন লিখিতভাবে আছে। তারপরও কেন মানা হবে না? সমস্যা হচ্ছে যাঁরা মানবেন, তাঁরাই ভঙ্গ করছেন। এটি বড় সমস্যা।

তদবিরের বিষয়ে রেলমন্ত্রীর বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। গতকাল সোমবার রেলভবনে মঞ্জুর-উল আলমের দপ্তরে গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে সাক্ষাৎ চাওয়া হলে জানানো হয়, তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। পরে তাঁকে ফোনেও পায়নি সমকাল।
ডিওতে রেলমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আমি মনে করি জনাব মঞ্জুর-উল আলম চৌধুরী দ্বিতীয় গ্রেড প্রাপ্তির যোগ্য এবং একটি অদৃশ্য কারণে তাঁর পদোন্নতি হতে তিনি বঞ্চিত এবং তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়েছে।’ তাঁকে দশম বিসিএসের রেলের দুই ক্যাডারের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকারী এবং মহাপরিচালকের পর জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা বলে ডিওতে দাবি করা হয়েছে।

যদিও রেল সূত্র সমকালকে নিশ্চিত করেছে, দুই ক্যাডারের যৌথ জ্যেষ্ঠতার তালিকা নেই। মঞ্জুর-উল আলম রেল প্রকৌশল ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। গতকাল সোমবারও রেলের ওয়েবসাইট যাচাই করে প্রকৌশল ও বাণিজ্যিক ক্যাডারের পৃথক জ্যেষ্ঠতার তালিকা দেখা গেছে। দ্বিতীয় গ্রেড প্রাপ্তির হিসেবে প্রকৌশল ক্যাডারে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এডিজি (অবকাঠামো) কামরুল আহসান এবং বাণিজ্যিক ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এডিজি (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী।

আগামী ১১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন রেলের ডিজি ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার। এ পদটি গ্রেড-১ পদমর্যাদার। ডিজি হতে গ্রেড-২ পদে পদোন্নতি পেতে হবে। মঞ্জুর-উল আলমের জন্য এই যোগ্যতা জোগাড় করতেই তাঁকে পদোন্নতি দিতে তদবির করেছেন রেলমন্ত্রী। এ বিষয়ে রেল সচিবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবার মতো আমিও গুঞ্জন শুনেছি।’ সচিব জানান, ডিজি নিয়োগের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়।

নথি বিশ্নেষণে দেখা গেছে, মঞ্জুর-উল আলমকে পদোন্নতি দিতে দুই বছর আগেই শুরু হয় তোড়জোড়। পদোন্নতির যোগ্য হতে বর্তমান পদে (ফিডার পদে) তিন বছর চাকরির বাধ্যবাধকতা পূরণের আগেই তাঁর পদোন্নতির প্রস্তাব করা হয়।
নুরুল ইসলাম রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। ওই বছরের ১১ জুলাই তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি পান মঞ্জুর-উল আলম। এই গ্রেডে থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে চলতি দায়িত্বে দ্বিতীয় গ্রেডের এডিজি পদে রয়েছেন। ফিডার পদে তিন বছর চাকরির শর্ত পূরণ না হলেও, তাঁকে দ্বিতীয় গ্রেডে পদোন্নতির প্রস্তাব ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বরের সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভায় উত্থাপন করা হয়। অভিজ্ঞতার শর্ত রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে প্রমার্জন সাপেক্ষে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়। ডিওতে রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রমার্জনের প্রস্তাব রেল মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হয় ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি।

মঞ্জুর-উল আলমের পদোন্নতির প্রস্তাব পাঠানোর আগের মাসে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৭ নভেম্বর রেলের যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান ফারুকীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটি করোনাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়, উচ্চমূল্যে চার কোটি ৬৩ লাখ টাকার কেনাকেটার বিষয়টি প্রমাণিত। কেনাকাটায় সম্পৃক্তদের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারে। মঞ্জুর-উল আলমসহ ২১ কর্মকর্তাকে ভবিষ্যতে সরকারি কেনাকাটায় সম্পৃক্ত না করতে সুপারিশ করে কমিটি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি থার্মোমিটার চার হাজার ৪০০ টাকা, পিপিই দেড় হাজার থেকে দুই হাজার ৯৫ টাকা, এন-৯৫ মাস্ক ২৫০ থেকে ৭২৭ টাকা, প্রতি লিটার স্যাভলন ৪৪২ থেকে ৭৫০ টাকা এবং কাপড়ের মাস্ক ৭০ টাকা দরে কিনেছিল রেলওয়ে। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সই বা দরপত্র কার্যক্রম সম্পন্নের আগেই থার্মাল স্ক্যানার স্থাপন করা হয়। অর্থাৎ আগেই জানা ছিল, কোন ঠিকাদার কাজ পাবে। মেটাল ডিটেক্টর, মাস্ক ও পিপিই সরবরাহের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন, এগুলোর মালিক ছিলেন একই ব্যক্তি। সিসিএস (পাহাড়তলী) দপ্তরের এমন ২৪টি দরপত্র অনুমোদন দিয়েছিলেন মঞ্জুর-উল আলম।

এরপরও তাঁকে পদোন্নতি দিতে বারবার প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রীর ডিওতে বলা হয়েছে, করোনাসামগ্রী কেনায় দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন অজ্ঞাত ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেয়। এ বিষয়ে মতামত জানতে ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ১৮ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় চিঠিতে জানানো হয়, মঞ্জুল-উল আলম সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত নন। তিন বছর চাকরির শর্ত প্রমার্জনেরও অনুরোধ করা হয়।

৪ ফেব্রুয়ারি ফের চিঠি দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। রেলওয়ে এরপর তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে সতর্ক করে। রেল সূত্রের ভাষ্য, অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিতেই এসব করা হয়েছিল। বিভাগীয় মামলা হলে পদোন্নতি আটকে যেত।
মন্ত্রীর ডিওতেও বলা হয়েছে, মঞ্জুর-উল আলমের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে, মামলা হয়নি। গত বছরের ২১ ডিসেম্বরের এসএসবি সভায় পদোন্নতির প্রস্তাব উস্থাপনের জন্য সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়। এই বছরের ২৭ মার্চ ফের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয় রেল মন্ত্রণালয়। গত ১৬ আগস্টের এসএসবি সভায় তা উত্থাপিত হলেও পদোন্নতি পাননি মঞ্জুর আলম।

চাকরির শর্ত প্রমার্জনের আর প্রয়োজন নেই জানিয়ে পদোন্নতি দিতে সুপারিশ করে মন্ত্রী ডিওতে লিখেছেন, মঞ্জুর-উল আলম বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার। তাঁকে গভীরভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী বলে আখ্যা দিয়েছেন মন্ত্রী।
ডিওতে বলা হয়েছে, মঞ্জুর-উল আলম দেশীয় প্রযুক্তিতে সাশ্রয়ী মূল্যে অচল ডেমু ট্রেন চালু করেছেন। গত ৯ অক্টোবর আয়োজন করে ডেমু সচল করে যাত্রী পরিবহনের উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী। তবে সমকালের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ডেমু সচলের বিষয়টিও পদোন্নতির স্বার্থে করা হয়েছে। নভেম্বর মাসে মাত্র চার হাজার ৬১৪ জন যাত্রী পরিবহন করেছে ডেমু। আয় হয়েছে মাত্র ৯২ হাজার ৩৮৮ টাকা।
রেল সূত্রের ভাষ্য, মন্ত্রী ও মঞ্জুর-উল আলমের যোগসূত্র তৈরি করে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের কাছ থেকে সোয়া ৩০০ কোটি টাকায় কেনা হয় ১০টি ইঞ্জিন। চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ তৈরি না হওয়ায়, তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নুর আহম্মদ হোসেন ইঞ্জিনগুলো গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
২০২০ সালের আগস্টে দেশে আনা ইঞ্জিনগুলোর বিষয়ে তদন্তে মঞ্জুর-উল আলমকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করে রেল মন্ত্রণালয়। কিন্তু পিডি অভিযোগ করেন, মঞ্জুর-উল আলম মূল দায়ীদের একজন। সমালোচনার মুখে অতিরিক্ত সচিব মো. ফারুকুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। প্রমাণ পাওয়া যায়, চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়নি। কিন্তু রেলের কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। বরং পিডি বদল করা হয়।

নুর আহম্মদ হোসেনের জবানবন্দি অনুযায়ী, পিডিকে অবহিত না করেই চুক্তিবহির্ভূত যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়। তা আড়াল করে পরামর্শক। কিন্তু রেলের তৎকালীন ডিজি শামসুজ্জামান চুক্তি অগ্রাহ্য করে পরামর্শককে প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শনের (পিএসআই) কাজের অনুমতি দেন। ফ্যাক্টরি অ্যাকসেপ্টসেন্স টেস্টে (এফএটি) ৫৮ কর্মদিবস লাগবে। কিন্তু ডিজির অনুমতি পাওয়ার মাত্র ১২ কর্মদিবসে এফএটি প্রতিবেদন দেয় পরামর্শক। পিএসআই সার্টিফিকেট দিয়ে ইঞ্জিনগুলো কোরিয়া থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর কাজ শুরু হয়। মঞ্জুর-উল আলম অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে পিএসআই সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ইঞ্জিন খালাসের জন্য চাপ দেন। প্রথমে পিএসআই সার্টিফিকেটে অসত্য তথ্য দেওয়া হয়। পরের সার্টিফিকেটে স্বীকার করা হয় চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ নেই। রেলমন্ত্রী পিডিকে অফিসে ডেকে নিয়ে ইঞ্জিন খালাস না করার কারণ জানতে চান। মিথ্যা পিএসআই সার্টিফিকেটের বিষয় মন্ত্রীকে জানানো হয়। তারপরও মন্ত্রী ইঞ্জিন খালাসের নির্দেশ দেন।