স্মার্ট প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটারের ভুতুড়ে বিলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে যশোর শহরের প্রায় অর্ধলক্ষ প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহক। গ্রাহকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ প্রিপেইড মিটারে টাকা রিচার্জ করলে একের পর এক চার্জ দেখিয়ে কেটে নেওয়া হয় মিটার একাউন্টের টাকা। এছাড়া নতুন ব্যালেন্সের সাথে পূর্বের ব্যালেন্স যোগ না হওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের।
জানা গেছে, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমল অর্থ্যাৎ ২০২০ সাল থেকে যশোর জেলা শহরে পুরাতন এনালগ মিটার পাল্টে স্মার্ট প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটারের সংযোগ দেওয়া হয়। এ সময় নতুন মিটার সংযোগ নেওয়ার সময় গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রিপেইড মিটার বাবদ কোন টাকা নেওয়া হয়নি। তবে এ স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের দাম ধরা হয় ৫ হাজার ৬০০ টাকা, যা প্রতি মাসে গ্রাহকের রিচার্জ করা টাকা থেকে ৪০ টাকা করে কেটে নেওয়া হবে। তবে দীর্ঘ চার বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও বিদুৎ বিভগের কাছে এ প্রিপেইড মিটারের মূল্য পরিশোধ হয়নি। ফলে প্রতি মাসে মিটার ভাড়া তো দিতেই হচ্ছে, একইসাথে নানান চার্জ দেখিয়ে প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করা ব্যালেন্স এমাউন্ট থেকে কয়েকশ টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। বিদুৎ বিভাগের এমন কর্মকান্ডকে দিনে দুপুরে প্রক্যাশে ডাকাতি বলে আখ্যায়িত করছে সাধারণ জনগণ। শুধু তাই নয় সদ্য পতন হওয়া সৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের দূর্নীতি ও সাধারণ জনগণের কাছ থেকে অর্থ লুটপাটের অন্যতম কৌশল বলেও অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসকল স্মার্ট প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটারে মাসে এক হাজার টাকা রিচার্জ করলে টোটাল চার্জ কর্তন করা হয় ১৬৬ দশমিক ৪৫ টাকা, মাসিক মিটার ভাড়া বাবদ কর্তন করা হয় ৪০ টাকা, ডিমান্ড চার্জ বাবদ কর্তন করা হয় ৮৪ টাকা, ভ্যাট কর্তন করা হয় ৪৬ দশমিক ৯ টাকা। সব চার্জ কেটে গ্রাহকের প্রিপেইড মিটারে ব্যালেন্স এসে দাড়ায় ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকার ঘরে। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার টাকা রিচার্জে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়। এছাড়াও গ্রাহকদের অভিযোগ বসতবাড়ির বৈদ্যুতিক ও্যারিং ভালো থাকা সত্বেও এবং কম সংখ্যাক বৈদ্যুতিক ডিভাইস ব্যবহারের পরেও ভুতের মতো হুহু করে প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করা টাকা ফুরিয়ে যায়।
যশোর পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাজীপাড়ার বাসিন্দা শুশান্ত বিশ্বাস বলেন, প্রতি মাসে এক-দেড় হাজার টাকা করে প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করি। রিচার্জ করার সাথে সাথে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নানা চার্জ দেখিয়ে মোবাইলে এসএমএস এর মাধ্যমে কেটে নেওয়া হয়। প্রতি মাসে যদি এভাবে আমার রিচার্জ করা টাকা থেকে এই বড় অংশের একটি টাকা কেটে নেওয়া হয় তাহলে তো বিদুৎ ব্যবহার করাই মুশকিল।’
একই এলাকার আলম হোসেন বলেন,আগে এনালগ মিটারে আমার বাসা-বাড়িতে মাসে ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা বিল উঠতো। এই প্রিপেইড মিটার স্থাপনের পর থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে রিচার্জ করি। তার থেকে ১৫০ টাকা তো কেটেই নেয় আবার বাকি ৮৫০ টাকা ২৪-২৫ দিনও যায় না। তার আগেই মিটারে টাকা ফুরিয়ে যায়।’
বেজপাড়ার এক মুদি ব্যবসায়ী নিলয় হালদার বলেন, ‘প্রিপেইড মিটার স্থাপনের সময় বলা হলো প্রতি মাসে রিচার্জ করা টাকা থেকে মিটার ভাড়া কেটে পরিশোধ করা হবে। আজ পর্যন্ত দীর্ঘ চার বছরে মিটারের ভাড়া পরিশোধ হয়নি। মিটার ভাড়াসহ নানান ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদি দেখিয়ে ভুতুড়ের মতো মিটার থেকে টাকা উধাও করে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই প্রিপেইড মিটার স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া আর এই বিদুৎ বিভাগের সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দূর্নীতি করে পকেট ভারি করা। অতি শীঘ্রই আমরা এ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে চাই।’
যশোর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) এর সভাপতি শাহিন ইকবাল বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটার স্থাপন করা হয়। এরপর থেকে এই প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের কাছ থেকে নানা অভিযোগ আমরা শুনছি। ভুতের মতো মিটার থেকে টাকা কেটে নিয়ে যায়। এই প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।’
তিনি বলেন, আমরা এর আগেও জনগনের এই দূর্ভোগ নিয়ে আন্দোলন করেছি। মিটার ভাড়া কি এ কয়বছরে এখনো পরিশোধ হয়নি? আর প্রতি রিচার্জে এতো টাকা কেটে নেওয়ার অর্থ কি? জনগণের সামনে এগুলো প্রকাশ করতে হবে। আমরা মনে করি দূর্নীতি অনিয়ম করে জনগণের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এই প্রিপেইড মিটার স্থাপনের একটা উদ্দেশ্যে। আমরা এর তদন্ত চাই, অন্যথায় আমরা সামনে দিনগুলোতে এই জনদূর্ভোগ নিয়ে কঠোর আন্দোলনে নামবো।’
বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ ওজোপাডিকো যশোর-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, ওজোপাডিকো যশোর-১ এর আওতায় যশোরে ২৩ হাজার স্মার্ট প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটার ব্যবহারকারী রয়েছে। তিনি বলেন, প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটার ভাড়া কতদিন কর্তন করা হবে এ বিষয়ে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই। এছাড়া গ্রাহকদের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মিটার ভাড়া ৪০ টাকা, সহ নিয়ম অনুযায়ী ভ্যাট ইত্যাদী কর্তন করা হয়। এর বাহিরে কোন টাকা কেটে নেওয়া হয় না।’
বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ ওজোপাডিকো যশোর-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী জিএম মাহমুদ প্রধান বলেন,অনেক সময় অনেক বাসাবাড়িতে বৈদ্যুতিক ওয়্যারিংয়ে সমস্যা থাকে যার কারণে বিদুৎ বেশি পোড়ে এবং মিটারের টাকা দ্রুত খরচ হয়। তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে এই স্মার্ট প্রিপেইড মিটার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। কেন গ্রাহক সেখান থেকে প্রিপেইড মিটার ক্রয় করলে তার মিটার থেকে কোন মিটার ভাড়া বাবদ কোন টাকা কেটে নেওয়া হবে না।