ঝিনাইদহে অনলাইন জুয়া, বাড়ছে সামাজিক অপরাধ ও আত্মহত্যার মতো ঘটনা

ঝিনাইদহে মারাত্বক আকার ধারণ করেছে অনলাইন জুয়া, বাড়ছে সামাজিক অপরাধ ও আত্মহত্যার মতো ঘটনা। অনলাইন জুয়া’য় আসক্তি ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধসহ সব বয়সী এমনকি নারীরাও এই অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। লোভে পড়ে খুয়াচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা-পয়সা ও সহায়-সম্বল। জুয়া’য় সর্বস্ব হারিয়ে হতাশায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে এই জেলাতে। জুয়ার মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারীদের কাছে পাচার হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বাংলাদেশের আইন ও প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে রীতিমতো প্রকাশ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় জুয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে জুয়ার অ্যাপসের প্রচারণা চলছে। চটকদার এসব বিজ্ঞাপনে প্রলোভিত হয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে অনলাইনে টাকা উপার্জনের নেশায়।
সম্প্রতি ঝিনাইদহে জুয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা, ঋণগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ছাড়া ও দাম্পত্য কলহের বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা পর্যক্ষেণ করেছি।
জানা গেছে, টিকে-৭৭৭, জয়া-৯৯৯, ক্যাসিনো-৭৭৭, হাউজ অব ফান, স্টার স্লট, লাকি স্পিন স্লট, ওয়ান এক্স বেট, লুডো কিং, তিন পাত্তি গোল্ড, ২৯ গোল্ড কার্ড গেম, বেট কুইন, ৩৬৫ বেটসহ অসংখ্য জুয়ার অ্যাপে আসক্ত হয়ে পড়ছে সব বয়সের মানুষ। এসব অ্যাপে বিকাশ ও নগদ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার চটকদার বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহার করা হয় জনপ্রিয় তারকা, ক্রিকেটার, রাজনৈতিক নেতার ছবি।
গত ১১ ডিসেম্বর বিষ পান করে আত্মহত্যা করে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বেতাই গ্রামের মোঃ লালু মিয়া (৩৫) নামের এক যুবক। সে বেতাই গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে। তার স্ত্রী ও ছোট ছোট ৩টি সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী নিলুফা খাতুনের সাথে কথা বলে জানাগেছে, লালু মিয়া মোবাইল জুয়া’য় আসক্ত হয়ে পড়ে। জুয়া খেলতে গিয়ে সে গরু বিক্রি করেছে, জমি বন্ধক রেখেছে। জাগরণী চক্র সহ ৪টি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা জুয়া’য় লাগিয়ে নষ্ট করেছে অবশেষে ঋণের বোঝার চাপে সে আত্মহত্যা করে। তার মৃত্যুতে ছোট-ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে মহাকষ্টে পড়েছে নিলুফা খাতুন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সদর উপজেলার গান্না বাজারে বড় মুদি ব্যবসায়ী মোঃ কবির হোসেন। তার ‘কবির স্টোর’এ প্রতিদিন পাইকারী-খুচরা মিলে দেড়-দুই লাখ টাকা বেচাকেনা হয়। স্থানীয় জুয়াড়ি যুবকদের প্ররোচণায় পড়ে সে জুয়া খেলতে শুরু করে। জুয়া লাভজনক ভেবে সে তার জনতা ব্যাংকের সিসি হিসাবের ১৫ লাখ টাকা ধিরে ধিরে জুয়া’য় হেরে যায়। এই ঘটনায় পারিবারিক কলহ তৈরি হলে পরিবার থেকে তার এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হয়।
কবির হোসেন প্রতিবেদককে বলেন, জুয়ার নেশায় আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। এখন আর এন্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করছি না। তাই আমার মতো কেউ যেন এই খেলা না খেলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর উপজেলার চান্দেরপোল গ্রামে তাইজেল হোসেনের ছেলে রেজাউল ইসলাম। সে দিন মজুরী ও বাজারে ছোট সবজির দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। ওই গ্রামের খিলাফত মন্ডলের ছেলে শরিফুল ইসলামের কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকায় এক খন্ড জমি বন্ধক নেওয়া জন্য এনজিওতে একটি ঋণের স্কিম করে। স্কিম করার জন্য শরিফুল ইসলামের কাছ থেকে ৪ হাজার টাকাও ধার নেয়। রেজাউল স্থানীয় জুয়াড়িদের প্রলোভনে পড়ে সেই টাকা দিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলতে গিয়ে প্রথম দিন কিছু লাভ হয়। তার পরে বেশি করে টাকা লাগিয়ে এনজিও থেকে ঋণ নেয় এবং তা জুয়া খেলে হেরে যায়।
রেজাউল ইসলাম নামের আরও একজন প্রতিবেদককে বলেন, শুনেছিলাম মোবাইলে খেলা করে অনলাইনে টাকা উপার্জন করা যায়। সেই জন্য জুয়ার অ্যাপস মোবাইলে নিয়ে খেলতে শুরু করি। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। তবে এসব এলাকায় অনেক কিশোর ছেলেরা জুয়া খেলে মোটরবাইক কেনাসহ বিলাসি জীবন যাপন করছে। তাদের উপার্জনের উৎস মানুষ জেনে জুয়াতে আরও উৎসাহিত হয়ে পড়ছে। সীমিত কয়েকজন জুয়াড়ি লাভবান হলেও বেশির ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ শহরের সরকারি কেসি কলেজ সংলগ্ন একটি মোবাইলের দোকান থেকে কয়েক বছর আগে জুয়া ছড়ানো হয়েছে। জেলায় সব জায়গায়ই জুয়া খেলে নিঃস্ব হচ্ছে, ঋণগ্রস্ত হয়ে অন্য অপরাধের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নেই কোন পদক্ষেপ।
এবিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অবস) মহিদুর রহমান বলেন, কারা কারা এই খেলা করছে এটা বিটিআরসি বলতে পারবে। তবে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র উদ্যোগ না নিলে আমাদের কিছুই করার নেই। এরা বিভিন্ন সেলিব্রেটির ছবি ব্যবহার করেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। রাষ্ট্র উদ্যোগ নিলেই কেবল জুয়া বন্ধ বা রোধ করা সম্ভব বলে মনে করি।