বন্ধ হচ্ছে ২টি আন্তর্জাতিক রুট, বছরে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত বিমান

চরম এয়ারক্রাফট ও পাইলট সংকটে আন্তর্জাতিক রুটে দিনে ২৫টির বেশি স্লট পরিচালনা করতে পারছে না বাংলাদেশ বিমান। এতে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে বিমান সংস্থাটি। এর সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্স। অভিযোগ আছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কালাকানুনের কারণে সামর্থ্য অনুযায়ী এয়ারক্রাফটও লিজ নিতে পারছে না বিমান। এই অবস্থায় এবারের হজ ফ্লাইট চালাতে গিয়ে বিমান সংকটে আগামী ৩ মাসের জন্য বন্ধ করা হচ্ছে ২টি আন্তর্জাতিক রুট। একই সঙ্গে সব আন্তর্জাতিক রুটের বেশ কিছু ফ্লাইটও ছেঁটে ফেলা হচ্ছে।

সিদ্ধান্ত ছিল বিমানের বহরে থাকা নিজস্ব বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ দিয়ে এবার ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইট চালানো হবে। এজন্য ২টি উড়োজাহাজ ভাড়া করা হবে। কিন্তু পরপর তিন দফা দরপত্র আহ্বান করেও কোনো উড়োজাহাজ পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ৭ এপ্রিল চতুর্থ দফায় ফের বিমান ভাড়া নিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে বেবিচকের অদক্ষ, উদ্ভট আর অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের কারণে এবারও মিলছে না ভাড়ার বিমান। বেবিচক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিমান কর্তৃপক্ষ যে উড়োজাহাজগুলো ভাড়া নেবে সেগুলোর বয়স ১৫ বছরের বেশি হওয়া যাবে না। ফলে ১ বছর কমিয়ে ১৪ বছর বয়সি উড়োজাহাজের জন্য বিমানকে দরপত্র আহ্বান করতে হয়েছে। জানা গেছে, বর্তমানে কোথাও ১৪ বছর বয়সি ভাড়ার উড়োজাহাজ নেই। এ অবস্থায় হজ ফ্লাইট চালাতে গিয়ে বিমান সংকটে কমপক্ষে দুটি আন্তর্জাতিক রুট বন্ধ করে দিতে হচ্ছে বিমানকে।

সূত্র জানায়, বিশ্বের অনেক দেশে এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়সের বাধ্যবাধকতা নেই। আইকাও অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশনের মানদণ্ড সম্পন্ন করা যে কোনো এয়ারক্রাফট লিজ নিতে পারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বিমান সংস্থা। কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। এদেশের বিমান সংস্থাগুলো এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৫ বছরের বেশি বয়সি বিমান ভাড়া নিতে পারছে না শুধু বেবিচকের কথিত নিষেধাজ্ঞার কারণে। অথচ বিশ্বের নামিদামি বিমান সংস্থাগুলোর বহরে ২০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সিও হাজার হাজার এয়ারক্রাফট এওসি (এয়ারওয়ার্দি সার্টিফিকেট) নিয়ে ফ্লাইট করছে। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল আইন অনুযায়ী এতে কোনো ধরনের ঝুঁকিও নেই। দেখা গেছে, বিশ্বের বিমান ভাড়া দেওয়া কোম্পানিগুলোর বহরে ১৫ বছর বয়সি উড়োজাহাজ নেই বললেই চলে। তাদের বহরে থাকা অধিকাংশ এয়ারক্রাফটের বয়স ১৭ থেকে ২০ বছর কিংবা আরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১৫ বছরের কম বয়সি এ উড়োজাহাজের ভাড়া অনেক বেশি। সে হিসাবে ১৭-২০ বছরের উড়োজাহাজের ভাড়া তার অর্ধেকেরও কম।

খোদ বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, চড়া দামে ১৫ বছরের কম বয়সি একটি উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রবাসী কর্মী (শ্রমিক) নির্ভর দেশ। রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার হিসাবে বিমান এসব প্রবাসীদের কম খরচে আনা-নেওয়া করার কথা। কিন্তু বিমানের বহরে এয়ারক্রাফট না থাকায় এসব প্রবাসীর অধিকাংশ চলে যাচ্ছেন বিদেশি ক্যারিয়ারের কাছে।

তা অভিযোগ, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সাবেক একজন মন্ত্রীর মেয়ে জামাতার একটি কোম্পানির কাছ থেকে উড়োজাহাজ ভাড়া নিতে বেবিচক ১৫ বছর নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের পরও বর্তমান বেবিচক কর্মকর্তারা সেই কালাকানুন রেখে দিয়েছেন। যতদিন এই বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা না হবে ততদিন বিমান কম দামের এয়ারক্রাফট ভাড়া নিতে পারবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমান সরকার প্রবাসীদের পক্ষে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। প্রবাসীকর্মীরা যাতে কম ভাড়ায় যেতে এবং আসতে পারেন সেজন্য টিকিট সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছে। বিমানবন্দরগুলোতে প্রবাসীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এখন অপেক্ষাকৃত কম দামে বিমানকে পর্যাপ্ত এয়ারক্রাফট ভাড়া নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারলে প্রবাসী শ্রমিকরা লাভবান হবেন।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুন নাসের খান যুগান্তরকে বলেন, যদি ২০ বছরের কোনো উড়োজাহাজ ফ্লাইট পরিচালনায় ঝুঁকি তৈরি না করে তাহলে বেবিচকের উচিত ১৫ বছরের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নেওয়া। এটি আরও যাচাই-বাছাই করে যতটা সম্ভব বয়স বাড়ানো যায় সেটা করা উচিত। কারণ বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ শ্রমিক বিদেশে আসা-যাওয়া করছেন। উড়োজাহাজের ভাড়া কম হলে টিকিটের ভাড়াও কমবে। আর ভাড়া বেশি হলে টিকিটের দাম বাড়বে এটা তো অর্থনীতির থিউরি।

ভাড়ায় মিলছে না উড়োজাহাজ, হজযাত্রীদের সেবায় বিভিন্ন রুটে ফ্লাইট কমাবে বিমান : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে বর্তমানে ভাড়ায় (লিজ) আনা দুটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ রয়েছে, যেগুলোর চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে এ বছর। মেয়াদোত্তীর্ণ উড়োজাহাজের ঘাটতি পূরণ ও আসন্ন হজ মৌসুমে যাত্রী পরিবহণের লক্ষ্যে সেপ্টেম্বরে নতুন করে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়ার উদ্যোগ নেয় বিমান। তবে তিন দফা দরপত্র আহ্বান করেও কোনো সাড়া পায়নি। ৭ এপ্রিল চতুর্থ দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, যাকে ‘শেষ চেষ্টা’ বলছেন বিমানের কর্মকর্তারা। দফায় দফায় দরপত্র আহ্বান করেও ভাড়ায় কাঙ্ক্ষিত উড়োজাহাজ আনতে না পারায় সামনের দিনগুলোয় ফ্লাইট চলাচলে ভয়াবহ সমস্যা হতে পারে বলে তারা জানিয়েছেন। সমন্বয় করতে হবে বিভিন্ন রুটের ফ্লাইটও। গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর বোয়িং ৭৩৭-৮ মডেলের দুটি উড়োজাহাজ লিজের জন্য প্রথম দফা দরপত্র আহ্বান করে বিমান। দরপত্রে উল্লেখ করা হয়, বিমান উড়োজাহাজ দুটি লিজ নেবে ৬ বছরের জন্য। এর মধ্যে প্রথম উড়োজাহাজটি চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ও দ্বিতীয় উড়োজাহাজটি ১ এপ্রিলের মধ্যে সংস্থাটির বহরে যুক্ত করার কথা ছিল।

বিমানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজগুলো দিয়ে চলতি হজ মৌসুমে যাত্রী পরিবহণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এজন্য সেগুলো বহরে যুক্ত করার সময়সীমা ১ এপ্রিল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্ত হলেও কাঙ্ক্ষিত উড়োজাহাজ বহরে আনতে পারেনি বিমান।

এমন প্রেক্ষাপটে বহরে থাকা বিদ্যমান উড়োজাহাজগুলো দিয়ে ২৯ এপ্রিল থেকে প্রি-হজ ফ্লাইট শুরু হচ্ছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২৯ এপ্রিল বেলা ৩টায় প্রথম হজ ফ্লাইট রওয়ানা দেবে। ওইদিন সব মিলিয়ে পরিচালনা করা হবে চারটি ফ্লাইট।’ হজ ফ্লাইটের কারণে অন্য রুটে বিমানের ফ্লাইট চলাচলে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হজ ফ্লাইটের জন্য আমরা কিছু ফ্লাইট সমন্বয় করব। কিছু রুট সমন্বয় করব। ফলে কোনো কোনো রুটে ফ্লাইটের সংখ্যা কমে আসতে পারে।’ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে বর্তমানে উড়োজাহাজ রয়েছে ২১টি।

এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, ছয়টি বোয়িং ৭৩৭ ও পাঁচটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ। এগুলো দিয়ে ২৩টি আন্তর্জাতিক ও সাতটি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান।

ভাড়ায় আনা দুটির চুক্তির মেয়াদ চলতি বছর শেষ হলে বিমানের উড়োজাহাজের সংখ্যা ১৯-এ নেমে আসবে। এমনটা হলে বিমানের ফ্লাইট পরিচালনায় একটু সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. সাফিকুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার জন্য গত কয়েক মাসে আমরা একাধিকবার দরপত্র আহ্বান করি। তিনবার আহ্বান করেও আমরা কোনো উড়োজাহাজ পাইনি। তাই শেষ চেষ্টা হিসাবে আরেকটা দরপত্র আহ্বান করেছি, যেটা ৭ এপ্রিল উন্মুক্ত হয়েছে। এখন দরপত্র উন্মুক্ত হওয়া মানে এই নয় যে আমরা উড়োজাহাজগুলো পেয়ে গেছি। যেসব দরপত্র জমা পড়বে, সেগুলো মূল্যায়নের পর সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে উড়োজাহাজ ভাড়া নেওয়া হবে। কিন্তু এবারও যদি উড়োজাহাজ সংগ্রহ করতে না পারি, তাহলে হয়তো কোনো একটা বিকল্প ব্যবস্থা করব।’ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিমানের যাত্রী পরিবহণের হার বেড়েছে জানিয়ে সংস্থাটির সিইও সাফিকুর রহমান বলেন, ‘যাত্রী চাহিদাও বাড়ছে। প্রচুর মানুষ এখন বিমানে ভ্রমণ করছেন। এমন অবস্থায় বহর ছোট হয়ে এলে একটু সমস্যা তো হবেই।