দীর্ঘদিনের দাবির ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক আন্দোলনের মুখে অবশেষে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জুলাই গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য দলটিকে নিষিদ্ধ করা এবং তাদের অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে তিন দিন ধরে শাহবাগ-যমুনাকেন্দ্রিক আন্দোলন চলছিল।
এই আন্দোলনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস এবং জুলাইকেন্দ্রিক গঠিত বিভিন্ন প্লাটফর্মের নেতা-কর্মীদের কর্মসূচিতে দেখা গেছে।
কিন্তু এসব গণজমায়েত-সমাবেশ-বিক্ষোভে জুলাই বিপ্লবে অংশ নেওয়া বিএনপিকেই দেখা যায়নি। এ নিয়ে ওই কর্মসূচিতে এবং অনলাইনে নানারকম আলোচনা চলছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত আসার পর বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে তারা আগেই প্রধান উপদেষ্টাকে লিখিতভাবে বলেছে। এছাড়া মৌখিকভাবে, বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও এই দাবি বিএনপির পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এ কারণে শাহবাগের আন্দোলনে অংশ নেয়নি তারা।
গত ৭ মে গভীর রাতে চুপিসারে আওয়ামী লীগ আমলের দুইবারের রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদ দেশত্যাগ করেন। এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার মধ্যে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে ৮ মে রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। এতে জুলাই বিপ্লবের অংশীদার দল ও প্লাটফর্মগুলোর নেতা-কর্মীরা অংশ নিতে থাকেন।
পরদিন ৯ মে শুক্রবার জুমার নামাজের পর যমুনার অদূরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বিশাল সমাবেশ করেন ছাত্র-জনতা। সেখান থেকে তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। ওই অবরোধে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অংশ নেন।
এই কর্মসূচি চলার মধ্যে এনসিপির আরেক মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম শাহবাগের আন্দোলনে বিএনপিকেও যোগদানের আহ্বান জানান। তিনি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘বিএনপি এবং তার অঙ্গসংগঠন ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দল এখন শাহবাগে। বিএনপি এলে জুলাইয়ের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায়। আজকের এই শাহবাগ ইতিহাসের অংশ এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির মানদণ্ড। ’ যদিও সেই আহ্বানে বিএনপির কাউকে মাঠপর্যায়ে সাড়া দিতে দেখা যায়নি।
পরদিন ১০ মে অর্থাৎ শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শাহবাগ মোড়ে আবার সমাবেশ শুরু হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সেখানে যোগ দেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এদিনও সেখানকার কর্মসূচিতে বিএনপি বা তার সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মীকে দেখা যায়নি।
তীব্র আন্দোলনের মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকে অন্তর্বর্তী সরকার। সেদিন রাতের ওই বৈঠকে জুলাই গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত পরে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়।
এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হতেই আন্দোলনরতরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। তবে এ সময় বিএনপি কর্মসূচিতে না আসায় তাদের বিরুদ্ধে স্লোগানও শোনা যায়।
এ বিষয়ে বিএনপির নেতারা বলছেন, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি অপরাধে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আইনি উপায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আগে থেকেই বলে আসছে। এমনকি এজন্য তারা সরকারের কাছে লিখিতও দিয়েছে। সেজন্য দলটি শাহবাগে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি।
শাহবাগের কর্মসূচিতে না যাওয়ার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রোববার (১১ মে) বাংলানিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে লিখিতভাবে কয়েক মাস আগে প্রধান উপদেষ্টাকে দিয়েছি, মৌখিকভাবে দিয়েছি, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য রেখেছি। আমাদের শাহবাগে গিয়ে এ কথা বলতে হবে কেন? আমরা শাহবাগে কেন যাব?’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় সন্ত্রাসীবিরোধী আইনে একটু সংশোধনী আনতে হবে, এজন্য এটি করে, বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে, আমরা সেটিকে স্বাগত জানিয়েছি। ’
এর আগে অবশ্য শনিবার রাতেই বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলেন, ‘কেবল নিষিদ্ধ করার মধ্যে দিয়েই জনগণ থেমে গেলে চলবে না। বিচার এবং গণহত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যে সর্বস্তরের জনগণকে মাঠে থাকতে হবে। শহীদদের রক্তের দাগ কখনো যাতে মুছে না যায়। ৬ আগস্টের স্লোগান মনে রেখে দিতে হবে। রশি লাগলে রশি নে, হাসিনারে ফাঁসি দে। ’
রোববার (১১ মে) এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গত ১০ ফেব্রুয়ারি আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তার হাতে দেওয়া পত্রে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছিলাম। ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সাথে সর্বশেষ সাক্ষাৎকালেও তার হাতে দেওয়া পত্রে আমরা পতিত ফ্যাসিবাদী দল ও সেই দলীয় সরকারের সঙ্গে যারাই যুক্ত ছিল তাদের বিচার দ্রুত করে দেশের রাজনীতির ময়দানকে জঞ্জালমুক্ত করার দাবি জানিয়েছি। আলোচনায় আমরা স্পষ্ট করে বলেছিলাম যে, আইনি প্রক্রিয়াতেই ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব ও উচিত। ’