নড়াইলে বোরো সংগ্রহ: কৃষকের লভ্যাংশ যাচ্ছে ডিসিফুড ও গুদাম ইনচার্জের পকেটে

নড়াইল সদর খাদ্য গুদামে ধান-চাল সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে । ভারপ্রাপ্ত ডিসিফুড ও গুদাম ইনচার্জ মিলে কৃষকের পরিবর্তে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান ক্রয় করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বাইরের জেলা থেকে ট্রাকে করে আনা হচ্ছে ধান। এতে ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে। তারা ঘটনার সঠিক তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির জন্য জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানাগেছে, চলতি বোরো ধান-চাল সংগ্রহ উপলক্ষে ব্যাপক অর্থ বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন নড়াইল জেলার ভারপ্রাপ্ত ডিসিফুড লায়লা আফরোজা ও সদর গুদাম ইনচার্জ আহসান হাবীব। এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল খাদ্য অধিদপ্তরের ৫১১ নম্বর স্মারকে নড়াইল সদরে ১৬৫৩ মেট্রিক টন ধান ও ২৮৪৯ মেট্রিক চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে । সরকারীভাবে এবার বোরো ধান কেনার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ টাকা ও চাল ৪৯ টাকা। বাজারে ধানের দামের তুলনায় সরকারের নির্ধারিত দাম বেশি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আগেভাগেই মাঠে নেমেছেন জেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা লায়লা আফরোজা। তিনি সদর খাদ্য গুদামের ইনচার্জ আহসান হাবীবের সাথে যোগসাজশ করে স্থানীয় কিছু ধান ব্যবসায়ীর মাধ্যমে একাধিক কৃষকের এনআইডি কার্ড সংগ্রহ ও তাদের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খুলে চেকে স্বাক্ষর করে নিয়েছেন।

এখন ওই কৃষকের নামে গুদামে ধান ক্রয় দেখানো হচ্ছে। গুদাম থেকে সিন্ডিকেট করে ধান ব্যবসায়ীদের কাছে অগ্রিম ৫০ কেজির খালি বস্তা দিয়ে দিচ্ছেন নড়াইল সদর গুদামের ইনচার্জ আহসান কবীর। ওই বস্তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা যশোরের নওয়াপাড়ার চাকই, পাচুড়িয়া, ফুলতলা সহ আশেপাশের বাজার থেকে নিম্নমানের ধান ক্রয় করে ট্রাকে করে সরাসরি মিলে নিয়ে যাচ্ছেন। আর নড়াইল সদর খাদ্য গুদামের খাতা কলমে আগের থেকেই রেডি থাকা কৃষকের নামে তালিকায় ওই ধান কেনা হয়েছে বলে জমা দেখানো হচ্ছে। গুদামে ধান বিক্রি করা কৃষকদের স্বাক্ষরগুলো জাল। সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওই স্বাক্ষর গুলো করে দিচ্ছেন। বিষয়টি নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত কৃষকের স্বাক্ষরের সাথে মেলালে বিষয়টি ধরা পড়বে। এছাড়া গুদামের খাতায় যেসব কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হয়েছে দেখানো হচ্ছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করলেও আদৌ তাদের কাছ থেকে ধান কেনা হয়নি সে বিষয়টি পরিষ্কার বেরিয়ে আসবে।

সুত্র বলছে, প্রকৃত কোন কৃষক গুদামে ধান নিয়ে গেলে ধানের মান খারাপ, সঠিক আর্দ্রতা নেই বলে নানা অজুহাত দেখিয়ে ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রকৃত কৃষকরা গুদামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না। প্রকৃত কৃষকদের সহায়তা করার সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ভেস্তে যাচ্ছে। নিম্নমানের ধান কিনে ফায়দা লুটছেন ভারপ্রাপ্ত ডিসি ফুড, টিসিএফ , গুদাম ইনচার্জ ও মধ্যস্থভোগী কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা। কিছু মিল মালিককে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে তাদের মাধ্যমেও ধান কেনা হচ্ছে। আর বাইরের জেলা থেকে কেনা ধানগুলো মিলাদের বলে প্রচার করে অনৈতিকতার বিষয়টি জায়েজ করা হচ্ছে।

ধান ছাড়াও চাল কেনাকাটায় মিলারদের থেকে নেয়া হচ্ছে মোটা অংকের উৎকোচ। ফলে গুদামে নিম্নমানের চাল দিতে বাধ্য হচ্ছেন মিলারেরা। গুদামে ক্রয়কৃত চালের মহেশ্চার পরীক্ষা করলে যা সত্যতা বেরিয়ে আসবে বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।

সুত্র বলছে, প্রথমে কিছু ধান কিনে গুদামে জমা করেছেন আহসান হাবীব। এরপর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কেনা ধান গুদামে না ঢুকিয়ে সরাসরি মিলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে পরিবহন খরচের টাকাও লুটপাট চলছে। অল্প সময়ের মধ্যে অধিক ধান ক্রয় ও মিলিংয়ের হিসাব নিকাশ করতে হিমশিম খাচ্ছেন গুদাম ইনচার্জ। সন্ধ্যার পরে চলছে টাকা ভাগাভাগি হিসাব। ভারপ্রাপ্ত ডিসিফুডকে ধান ক্রয়ে কেজি প্রতি ৫০ পয়সা দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সুত্র বলছে, ভারপ্রাপ্ত ডিসিফুড লায়লা আফরোজা নড়াইল সদর ছাড়াও ধান চাল কেনাকাটায় কালিয়া এবং লোহাগড়ার ওসি এলএসডিদের কাছ থেকে একইভাবে অর্থ বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। ওই কর্মকর্তার খায়েস পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন গুদাম ইনচার্জরা। সমগ্র জেলাব্যাপী চলছে একই অনিয়ম ও অপকর্ম।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে নড়াইল সদর খাদ্য গুদামের ইনচার্জ আহসান কবীর অভিযোগের বিষয়গুলো অস্বীকার করে বলেন,  কে বলেছে কৃষকের ধান নেয়া হচ্ছে না? আপনি গুদামে এসে দেখে যান কৃষকের লাইন কত বড়। নড়াইল সদর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র মুখার্জী বলেন, গুদামে কোন ট্রাকে ধান ঢুকছে না। কারো কাছ থেকে কোন সুবিধাও নেয়া হচ্ছে না। নড়াইল জেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা লায়লা আফরোজা এর সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি ধান ক্রয়ের অনিয়মের বিষয়গুলো অস্বীকার করেন। নড়াইলের বাইরে থেকে ধান আনা হচ্ছে তার ছবি ও ভিডিও আছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হলে তিনি বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে নিজেদের নির্দোষ বলে দাবী করেন। এমনকি মিল মালিকেরা ওই ধান আনতে পারে বলে যুক্তি দেখান।

উল্লেখ্য, মিল মালিকেরা ৫০ কেজির বস্তায় বাজার থেকে ধান কেনেন না। ৫০ কেজি বস্তায় ধান কেনা হলে তাদের খরচ আরও বেড়ে যায়। মিল মালিকরা ধান ক্রয় করেন ৬০ কেজির বস্তায়।