গত মে মাসের শুরুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চারদিনের সংঘাত উভয় দেশকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। এসময় আকাশযুদ্ধে পাকিস্তানের হাতে থাকা চীনা যুদ্ধবিমানের কার্যকারিতাও প্রকাশ পায়।
এ ঘটনায় তুমুল সাড়া পড়ে প্রতিরক্ষা শিল্পের দুনিয়ায়। এরপর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের আরও আগ্রহ বেড়েছে চীনা অস্ত্র-সরঞ্জামের ওপর।
এরইমধ্যে খবর বেরিয়েছে, চীনের কাছ থেকে জে-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট কিনছে পাকিস্তান। বেইজিংয়ের সঙ্গে বড় একটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় চুক্তির অংশ হিসেবে ইসলামাবাদ এই যুদ্ধবিমান পাবে।
বিশ্বের শীর্ষ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিষয়ক প্রকাশনা জেনস নিশ্চিত করেছে, পাকিস্তান শিগগিরই চীনের উন্নত প্রযুক্তির জে-৩৫এ স্টেলথ ফাইটার যুদ্ধবিমান পাচ্ছে। এটি শেনইয়াং নির্মিত এফসি-৩১ ‘গায়রফ্যালকন’-এর রপ্তানিযোগ্য সংস্করণ। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই যুদ্ধবিমান সরবরাহ শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।
চীনের শেনইয়াং এয়ারক্রাফট করপোরেশন নির্মিত জে-৩৫এ যুদ্ধবিমান পাকিস্তান বিমানবাহিনীর জন্য স্টেলথ প্রযুক্তি ও যুদ্ধ সক্ষমতায় বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শত্রুর রাডারে ধরা না পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য, উন্নত সেন্সর ও বহু ভূমিকার উপযোগী ডিজাইনসহ এই বিমানটি নানা ধরনের মিশনে অংশ নেওয়ার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে।
জেনসকে এক ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তা জানান, চীনের পঞ্চম প্রজন্মের এই যুদ্ধবিমান ব্যবহারকারী প্রথম আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিএএফ)।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যুদ্ধবিমানগুলো আসতে শুরু করবে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে পিএএফ-এর পাইলটরা চীনে গিয়ে জে-৩৫এ পরিচালনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তবে মোট কতটি বিমান কেনা হচ্ছে কিংবা চুক্তির আর্থিক ও কৌশলগত শর্তাবলি সম্পর্কে এখনো কিছু প্রকাশ করা হয়নি।
জেনস ডিফেন্স নিউজের তথ্য অনুযায়ী, এই সংগ্রহ পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা কৌশলে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করছে। এর ফলে পাকিস্তান বিশ্বের গোনা কয়েকটি দেশের কাতারে চলে গেল যারা পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান পরিচালনা করছে।
এই চুক্তি চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের কৌশলগত প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে আরও সুদৃঢ় করেছে, বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মের সামরিক ফ্লাইট প্রযুক্তির ক্ষেত্রে।
আঞ্চলিক দেশগুলোর বিমানবাহিনী যখন পঞ্চম প্রজন্মের প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোচ্ছে, তখন জে-৩৫এ সংযোজন ভবিষ্যতের আকাশযুদ্ধে পিএএফকে কৌশলগত সুবিধা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদনের অনুযায়ী, ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের এফ-২২ র্যাপ্টর স্টেলথ ফাইটার প্রথম আকাশে ওড়ার পর থেকেই পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলো আকাশপথের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছে।
এই অত্যাধুনিক ফাইটারগুলোতে থাকে উচ্চ পর্যায়ের ম্যানুভারিং ক্ষমতা, উন্নত ইলেকট্রনিক্স সিস্টেম, সুপারক্রুজের সক্ষমতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে—শত্রুর রাডারে ধরা না পড়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। একাধিক দিক থেকে ভয় জাগানো ও প্রশংসিত এসব বিমান বিশ্বের সেরা বিমানবাহিনীর চাহিদার শীর্ষে রয়েছে।
এ পর্যন্ত মাত্র চারটি বিমানকে ‘পঞ্চম প্রজন্মের’ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে—লকহিড মার্টিন নির্মিত যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ ও এফ-৩৫, চীনের জে-২০ এবং রাশিয়ার সু-৫৭।
বর্তমানে ১২টি দেশ এই চারটি মডেলের যেকোনো একটির অপারেটর। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে এই তালিকায় আরও আটটি দেশ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনে উৎপাদিত জে-১০সিই যুদ্ধবিমান নিয়ে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা গভীর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার সময়ে এই যুদ্ধবিমানটি তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। নির্ভুল আঘাত হানার সক্ষমতা ও যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তব সময়ের প্রস্তুতির দিক থেকে জে-১০সিই বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
জে-১০সিই’র সফলতা পাকিস্তানে চীনের মহাকাশ প্রযুক্তির ওপর আস্থা আরও জোরদার করেছে বলে জানা গেছে। এর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আরও উন্নত যুদ্ধবিমান, বিশেষ করে জে-৩৫এ অধিগ্রহণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
জে-৩৫এ নিজেদের বহরে যুক্ত করতে চলেছে পাকিস্তান, যা থেকে স্পষ্ট—পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিএএফ) অঞ্চলের আধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের আকাশযুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজেদের শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
পঞ্চম প্রজন্মের এ যুদ্ধবিমানের ফলে কী লাভ হবে?
পাকিস্তানের সেন্টার ফর অ্যারোস্পেস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের বিভাগীয় পরিচালক এয়ার কমোডোর রেজা হায়দার বলেন, এর ফলে একজন পাইলট প্রথম দৃষ্টিতে, প্রথম শট, প্রথম হত্যা করার ক্ষমতা পাচ্ছে। অর্থাৎ অন্য বিমানগুলো আমাকে রাডারে দেখতে পারছে না, তার আগেই তার ওপর আক্রমণ করার এবং ধ্বংস করার ক্ষমতা থাকবে এ বিমানে।
যুদ্ধবিমানের এ সক্ষমতা সেকেন্ডে সেকেন্ড পরিবর্তন হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে আকাশে আধিপত্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, এজন্য এ বিষয়টি এত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এ বিমানের দ্বিতীয় উপকারিতা হল এটির মাধ্যমে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ মাটি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণের জন্য ক্ষেপণাস্ত্রগুলোও আমাকে দেখতে পারছে না।
দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট ‘স্টেলথ’ প্রযুক্তির জে-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রথম বার আকাশে ওড়ে ২০১২ সালে। যে কোনও পরিবেশে সমান দক্ষতায় হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে এই লড়াকু জেটের।
‘স্টেলথ’ প্রযুক্তির হওয়ায় সহজে এটি শত্রুর রাডারের নাগালে আসবে না। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এর জে-৩৫এ ভ্যারিয়েন্টটি তৈরি করে ‘শেনইয়াং’। পাকিস্তানই প্রথম দেশ, যাকে এই যুদ্ধবিমান রফতানি করছে বেইজিং।