যখন মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষেপণাস্ত্র বৃষ্টি নেমে এসেছে এবং ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা তীব্রতর হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের মিত্রকে অস্ত্র সরবরাহ করলেও সরাসরি যুদ্ধে জড়াচ্ছে না। এই কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার পেছনে রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ চিন্তা: ২০২৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপ সফলভাবে আয়োজন করা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়া আসরটি শুরু হতে আর মাত্র এক বছর বাকি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকো মিলে আয়োজিত এই আসরে যেন কোনো বৈশ্বিক সংকটের ছায়া না পড়ে, সেজন্য নীতিনির্ধারকরা এখন যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চান।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, ওয়াশিংটনের হিসাব-নিকাশ
সম্প্রতি ইরান ৩০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে হাইপারসনিক (অতি-দ্রুতগামী) প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে এবং বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
ইসরায়েলিরা আয়রন ডোম, ডেভিড’স স্লিং এবং অ্যারো-থ্রি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেকগুলো হামলা প্রতিহত করেছে। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, যুদ্ধ দীর্ঘ হলে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আরও গভীরভাবে জড়াতে হবে।
দ্য ইকোনমিক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিরাতে ইসরায়েল ২৮৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়। এই হারে চলতে থাকলে অস্ত্র মজুদ আর মাত্র ১২-১৪ দিন টিকবে।
তবুও হোয়াইট হাউস সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে আছে। ইসরায়েলের প্রতি জোরালো সমর্থনের কথা বারবার বললেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে সম্মতি দেননি। তার প্রশাসন বরং দ্রুত অস্ত্র সরবরাহ, রিয়েল-টাইম গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণের পথ অনুসরণ করছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হোয়াইট হাউস আশঙ্কা করছে যে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকা যুদ্ধকে আরও বিস্তৃত করতে পারে, যার ফলে আসন্ন বিশ্বকাপের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা হুমকির মুখে পড়বে।
গতকাল বুধবার ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি বলেন, “আমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক সেকেন্ড আগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করি। বিশেষ করে যুদ্ধের বিষয়ে, কারণ যুদ্ধ খুব দ্রুত এক চরম অবস্থা থেকে আরেক চরম অবস্থায় চলে যেতে পারে। ”
মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারাও স্পষ্ট করে বলেননি তারা কোন পথে এগোবেন।
২০২৬ বিশ্বকাপ: ৫ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন ঝুঁকিতে
বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে উত্তর আমেরিকায় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই ৬০টি ম্যাচ আয়োজন করবে, যার মধ্যে নিউ জার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে ফাইনাল।
গ্লোবালস্পোর্ট স্ট্র্যাটেজিস-এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মরগান লেফলার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক ভ্রমণ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। এতে ভ্রমণ ব্যয়, দর্শকসংখ্যা, কর্পোরেট স্পন্সর ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা—সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ‘
এছাড়া বিশ্বকাপের স্পন্সররাও চিন্তিত। ফিফার এক ইউরোপীয় অংশীদার বলেছেন, ‘যুদ্ধকালীন বিশ্বকাপে বিজ্ঞাপন দেওয়া বিপজ্জনক,এতে ব্র্যান্ড ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিমা খরচ বেড়ে যায়। ‘
যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে যুদ্ধজনিত ঝুঁকির আশঙ্কায় কিছু নিরাপত্তা পরিকল্পনা আপডেট করছে।
‘সফট পাওয়ার’ এর লড়াই
বিশ্বকাপ শুধু ক্রীড়া নয়—এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তি গঠনের সুযোগ। রাজনৈতিক বিভাজন, কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার ও বৈদেশিক নীতির নানান ব্যর্থতার পর এই আসর আমেরিকাকে একটি ঐক্যবদ্ধ, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও নেতৃত্বশীল জাতি হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ দিচ্ছে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক জেমস রলস্টন বলেন, ‘বিশ্বকাপ হবে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দেখা অনুষ্ঠান। যদি ২০২৫ বা ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে ফুটবল নয়, টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাবে সেনাদের পদচারণা। ‘
যুদ্ধ কীভাবে বিশ্বকাপকে বিপন্ন করতে পারে?
– বিশ্বকাপের আয়োজক শহরগুলোতে সন্ত্রাসবাদের হুমকি বাড়বে। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপ থেকে আগত দর্শকদের জন্য ভিসা ও নিরাপত্তা জটিলতা বাড়তে পারে। তাছাড়া ইরান সপ্তমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটির পক্ষে আগামী বিশ্বকাপে খেলা কতটুকু সম্ভব সে প্রশ্নও থাকছে।
– তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, বিমা খরচ বৃদ্ধি, বিমানের শিডিউল ভেঙে পড়া এবং বাজার অস্থিরতার কারণে আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীর সংখ্যা কমে যেতে পারে, বাড়বে আয়োজকদের খরচ। তাছাড়া ট্রাম্প সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে সৌদি আরব ও কাতারের সঙ্গে কয়েক শ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি করে এসেছেন। সেগুলোর ভবিষ্যতও এখন হুমকির মুখে।
– বিশ্বকাপের সঙ্গে যুক্ত বহু আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যুদ্ধকালীন সময়ে নিজেদের ইমেজ রক্ষায় বিনিয়োগ বন্ধ বা বিলম্বিত করতে পারে।
– ট্রাম্প প্রশাসন চায়, বিশ্ব শুনুক—“আমেরিকা ফার্স্ট” এখন বিশ্বসেরা বিশ্বকাপ আয়োজন করছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে ক্রীড়া নয়, জিইউপি (জিও-পলিটিক্স) হবে খবরের মূল আলোচ্য।
ট্রাম্পের ভারসাম্যের খেলা ও সম্ভাব্য পরিণতি
ট্রাম্প প্রশাসন যেমন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে, তেমনি ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এরই অংশ হিসেবে আজ ক্লাব বিশ্বকাপে অংশ নিতে আসা জুভেন্টাস ফুটবল দলকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প, নিজে খেলোয়াড়দের শুভেচ্ছা জানান।
ওভাল অফিসে তিনি খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাপ করেন এবং ফুটবল, ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলেট ইস্যু ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করেন। অর্থাৎ, ট্রাম্প শান্তির বার্তা দিচ্ছেন। কিন্তু চলমান ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের কিছুটা প্রভাব এবারের ক্লাব বিশ্বকাপেও পড়েছে। কারণ খেলার চেয়ে যুদ্ধের দিকেই পুরো বিশ্বের মনোযোগ। গ্যালারি প্রায় ফাঁকাই থাকছে, টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় কেবল যুদ্ধের খবরে সয়লাব।
ইরান ও ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের কারণে ইরানের রাজধানী তেহরানে আটকে পড়েছেন ইন্টার মিলানের ফরোয়ার্ড মেহদি তারেমি। ফলে ক্লাব বিশ্বকাপে দলের সঙ্গে থাকতে পারছেন না এই ইরানি ফরোয়ার্ড।
পরিস্থিতি দেখে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই মুহূর্তে শান্তি শুধু নৈতিক চাহিদা নয়, বরং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও। ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ একটি ‘সফট পাওয়ার’—যা আমরা হারাতে পারি না। ‘
সবমিলিয়ে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যতই ভয়াবহ হোক, যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে কোনোভাবেই সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। কারণ তাদের সামনে রয়েছে বিশ্বজয়ের আরেক যুদ্ধ, ফুটবলের যুদ্ধ, ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ। এই আসর শুধু ক্রীড়ার নয়, বরং আমেরিকার গ্লোবাল ব্র্যান্ডিংয়ের প্রতীক হতে যাচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন ২০২৬ বিশ্বকাপকে শান্তিপূর্ণ, সফল এবং রাজনৈতিকভাবে লাভজনক করতে চায়। যুদ্ধ সেই লক্ষ্যকে শুধু বিপন্নই করবে না, ডুবিয়ে দেবে।
তথ্যসূত্র- দ্য ইকোনোমিক টাইমস, নিউইয়র্ক পোস্ট, ওয়াশিংটন পোস্ট ও এপি।