বিএনপি এলে এক, না এলে আরেক

ডেস্ক রিপোর্ট: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোটের মধ্যে এখনই আলোচনা চায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা। তবে আওয়ামী লীগ অপেক্ষা করতে চায়। কারণ বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না; এলে পুরো বিএনপি আসবে নাকি আংশিক আসবে এবং জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে, সেটা নিশ্চিত হওয়ার পর ১৪ দলের মধ্যে আসন নিয়ে সমঝোতায় বসতে চায় আওয়ামী লীগ। খবর প্রথম আলো।

আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের উচ্চপর্যায়ের সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তবে জোটের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ মুহূর্তে আসন নিয়ে সমঝোতায় বসলে জোটের অপেক্ষাকৃত ‘ছোট’ দলগুলো কিছুই পায় না। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে চারটি দলের ১৫ জন সাংসদ হন। অবশ্য এর বাইরেও শরিকদের কেউ কেউ নির্বাচনে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি বলে সাংসদ হতে পারেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ বেশি দেখানোর জন্য তাঁদের বসানো হয়নি।

আগামী ডিসেম্বরের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট বর্জন করে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন দুর্নীতির মামলায় কারাগারে। এই অবস্থায় বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

জোটের একটি সূত্র জানায়, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে গণভবনে যান ১৪ দলের নেতারা। এ সময় তাঁরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোটের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতে শেখ হাসিনার কাছে অনুমতি চান। জবাবে জোটের প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৪ দলকে নিয়ে জোটগতভাবেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে। তবে আসন সমঝোতা কবে থেকে শুরু হবে, তা পরিষ্কার করেননি।

এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ১৪ দলের বৈঠকে শরিকদের কেউ কেউ আসন বণ্টনের বিষয়টি আকারে-ইঙ্গিতে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা এগোতে দেয়নি।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি ও আসন বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে জোটে টুকটাক আলোচনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করার জন্য তাঁরা জোটের প্রধান শেখ হাসিনাকেও অবহিত করেছেন। তবে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হয়, সেটাও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। তবে ১৪ দলের মধ্যে আলোচনা যত দ্রুত শুরু করা যায়, ততই ভালো।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর নির্বাচন নিয়ে জোটে আলোচনা হতে পারে। তবে আসন বণ্টন আরও দেরি হবে। জোটের শরিকেরা নিজেদের মধ্যে যে আলোচনা করছে, তাতে সব মিলিয়ে তাদের চাহিদা ৭০-৮০টি আসন। তবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে গতবারের চেয়ে কম আসনের বিনিময়ে জোট ধরে রাখার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ।

১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সম্প্রতি ১৪ দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। জোটগতভাবেই নির্বাচন হবে। যেখানে যে প্রার্থী শক্তিশালী, তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। জোটের শরিক না আওয়ামী লীগের, সেটার চেয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা বেশি দেখা হবে। গত নির্বাচনে জোটের যাঁরা সাংসদ হয়েছেন, তাঁদের অবস্থান ঠিক আছে কি না এবং এর বাইরে কেউ শক্তিশালী প্রার্থী আছেন কি না, তা-ও দেখা হচ্ছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জোটের শরিক জাসদ ৩টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি আসনে জয়ী হয়েছিল। মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টি পায় ২৭টি আসন। জোটের মনোনয়ন না পাওয়ায় সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়াকে মন্ত্রী করা হয়। গত নির্বাচনের পর শরিক দলের রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুকে মন্ত্রী করা হয়। যেসব দলের কোনো সাংসদ নেই, তাদের সরকারি কোনো সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয়নি। শরিকদের মধ্যে কোনো কোনো দল আছে, যারা অন্তত একটা আসন পেলেই খুশি।

১৪ দলের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাহাদাৎ হোসেন বলেন, বর্তমান সংসদে তাঁদের কোনো সাংসদ নেই। এবার তাঁরা বেশ কিছু আসনে জোটের সমর্থন পাবেন বলে আশা করছেন।

২০০ আসনে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে আওয়ামী লীগ
সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আসন বণ্টন শুধু জোটের একার ওপর নির্ভর করে না। বিএনপি নির্বাচনে আসা না-আসার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। আবার বিএনপির কৌশল দেখে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির অবস্থান ঠিক করা হবে। পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একটা অংশকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে। এ ছাড়া বামপন্থী কিছু দলকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করা বা তাদের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করার চেষ্টা হতে পারে। সবকিছু নির্ধারিত হবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। তবে আওয়ামী লীগ ২০০ আসনে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। বাকি ১০০ আসন নিয়ে জোট-মহাজোটের শরিকসহ সমমনাদের সঙ্গে সমঝোতার পরিকল্পনা আছে। শেষ পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ও আছে কারও কারও। কারণ, অনেক আসনে আওয়ামী লীগেরই অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন।

দর-কষাকষিতে কারা গুরুত্বপূর্ণ
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, ১৪-দলীয় জোটে কোনো বিভেদ না থাকলেও পাওয়া না-পাওয়ার অসন্তোষ আছে। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে শরিকদের অবস্থান তত ভালো নয়। ফলে আসন নিয়ে দর-কষাকষিতে তারা পিছিয়ে আছে। তবে আসন না পেয়ে জোট ছেড়ে যাওয়া বা আওয়ামী লীগের বিকল্প কিছু ভাবার মতো অবস্থাও নেই তাদের। জোটনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আসন নিয়ে দর-কষাকষি করার মতো নেতাও এই মুহূর্তে শরিকদের মধ্যে নেই। বড়জোর ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিমের কাছে নিজেদের দাবির কথা বলতে পারেন।

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই পায় ২৩৫টি আসন। জোটের শরিকেরা পায় ১৫টি আসন। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ৬ টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৫ টি, তরীকত ফেডারেশন ২টি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি) ২টি আসন। পরে জাসদ ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন অংশে ২ জন সাংসদ আছেন। আর শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন অংশে ২ জন। বগুড়া-৪-এর সাংসদ এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন এদিক-ওদিক করে এখন নিরপেক্ষ। ফলে জাসদের কোন অংশ দলীয় প্রতীক পাবে, এই নিয়ে নির্বাচন কমিশনে দেনদরবার চলছে।

জাসদের একাংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, যেহেতু ভোটের বেশি দেরি নেই, জোটে এই নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়াই উচিত। তাঁদের দলের নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়টিও নির্বাচন কমিশনের ফয়সালা করা দরকার।

এর বাইরে জাতীয় পার্টি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশ হয়ে নির্বাচন করে। গতবার এইচ এম এরশাদের নানা নাটকের পর জাতীয় পার্টি ৩৩টি আসন পেয়েছে। এর বাইরে বিএনএফ (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট) নামে নতুন দল একটি আসনে জেতে। বাকি ১৬ আসন পান স্বতন্ত্র সাংসদেরা। তাঁদের একজন রুস্তম আলী ফরাজী পরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। অন্যরা আওয়ামী লীগেরই নেতা, প্রায় সবাই দলে ফিরে গেছেন।

শরিক একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কখনো কখনো মনে হয় ১৪ দলের শরিকেরা আওয়ামী লীগের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় শরিকদের দেওয়া নাম থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অধিকাংশ কমিশনার নিয়োগ হন। আবার কখনো মনে হয় আওয়ামী লীগের দয়ার ওপর আছেন তাঁরা। কারণ, আওয়ামী লীগ মনে করে শরিকদের যাওয়ার জায়গা নেই। ওই নেতা মনে করেন, আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মূল দর-কষাকষি হবে এরশাদের জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরীকত ফেডারেশনসহ কিছু দলের। এর সঙ্গে ধর্মভিত্তিক কিছু দল ও গোষ্ঠীর কিছু চাওয়াও গুরুত্ব পাবে।