’৯০-এর আদলে প্ল্যাটফরম গড়তে চায় বিএনপি

ডেস্ক রিপোর্ট: রাজনৈতিক মিত্রদের নিয়ে বৃহত্তর প্ল্যাটফরম গড়তে ঐকমত্য হয়েছে বিএনপিতে। ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ মেনি-ফেস্টোতে একে এখন ‘সাংগঠনিক রূপ’ দেওয়া হবে। এরশাদবিরোধী ১৫ দল এবং ৭-দলীয় জোটের নেতৃত্বে যেভাবে যুগপৎ আন্দোলন হয়েছে, ওই ধরনের আন্দোলন নিয়ে তাদের আলোচনা হচ্ছে। সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগেই এ রাজনৈতিক ঐক্য প্রকাশ্যে আসবে।

সম্প্রতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের টাঙ্গাইলের বাসাইল পৌরসভার নির্বাচনে একজন মেয়রপ্রার্থীকে বিএনপি সমর্থন দিয়েছিল। আসন্ন রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি নির্বাচনেও এ প্ল্যাটফর্ম ভেতরে ভেতরে কাজ করবে।

জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাইরে তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গড়ার চেষ্টা করে আসছিলাম। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করায় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রতি জোর দিয়েছি। বিএনপিও এই ঐক্য গড়তে জোর দেয়। এ অবস্থায় সার্বজনীন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, শহীদ মিনারে নারীর শ্লীলতাহানি এবং সিটি নির্বাচনগুলোয় বিনাভোটে সরকারের ভোট কারচুপি ইত্যাদি দেখার পর আমরা একমত হয়েছি এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। নির্বাচনের আগে যেকোনো সময় এই ঐক্য দৃশ্যমান হবে।’

বিএনপি নেতারা জানান, বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম গড়তে লন্ডন থেকে মূল কাজ করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ঢাকায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গয়েশ্বরচন্দ্র রায় ও নজরুল ইসলাম খান।

ঈদের আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে দুই নেতা একান্তে কথা বলেন। বিএনপি মহাসচিবের উপস্থিতিতে সেখানে একটি অনুষ্ঠানে তারেক রহমান জাতীয় ঐক্যের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন।

বিএনপি ও তার সমমনা মিত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে ২০ দলের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলো মৌখিকভাবে এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির ব্যাপারে একমত হয়েছে। জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপির নতুন মিত্রদের কোনো আপত্তি থাকবে না। কারণ নতুন রাজনৈতিক মিত্ররা জোট করবে বিএনপির সঙ্গে, ২০ দলের সঙ্গে নয়। সেক্ষেত্রে ২০ দলে কারা থাকল এই নিয়ে নতুন মিত্রদের এখন পর্যন্ত কোনো আপত্তি নেই। তবে জামায়াত যদি জোটে থাকতে না চায়, তাদের বাধাও দেওয়া হবে না। বিএনপি এবং তার মিত্র দলগুলো চেয়েছিল খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে এ প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে। কিন্তু নির্বাচনের আগে তার বের হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়ায় উদ্যোক্তাদের নতুনভাবে বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে।

বিএনপি সূত্র বলছে, বিএনপি সমর্থক কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এ প্ল্যাটফর্ম তৈরির নেপথ্যে কাজ করছেন। জামায়াতকে রেখেই এই ঐক্য গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন তারা। উদ্যোক্তাদের কয়েকজন মনে করেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগের বাইরে সব দলকে প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তাদের অন্যতম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এখন সবার বিপদ। এই বিপদে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সে বিবেচনায় নিয়ে এই ঐক্য গড়তে সবাই রাজি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মান্না আরও বলেন, ‘জামায়াতের তো নিবন্ধন স্থগিত। তাদের বিএনপি কীভাবে হ্যান্ডেল করবে এটি তাদের ব্যাপার। বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোট হবে। বিএনপি ও নতুন মিত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই জোট শুধু সরকার পরিবর্তন বা নতুন সরকার গঠনে কাজ করবে না। তারা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনও আনবে। বিশেষ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। সন্ত্রাস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় এবং রাজনীতিসহ সব স্তরে পরমতসহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্য়বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, যেহেতু সামনে জাতীয় নির্বাচন, সে কারণে বৃহত্তর ঐক্য হওয়া দরকার। একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই বৃহত্তর ঐক্য হতে হবে।

বিএনপি সূত্র জানায়, তাদের মূল লক্ষ্য ২০-দলীয় জোটের বাইরে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা। নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা গঠন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সব দলের অংশগ্রহণে কিছু কর্মসূচি করে একটি বার্তা দেওয়া। একটি জাতীয় কনভেনশন করার ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা রয়েছে।

এর আগে বিএনপি অনেক দিন ধরেই এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করার চেষ্টা করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ২০১২ সালে এ উদ্যোগ নিয়েছিল। সে সময় দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, বিকল্পধারা, জাসদ (রব), নাগরিক ঐক্যসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ গুলশানে জঙ্গি হামলার পর খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে এই পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছিল, সেটিও সম্ভব হয়নি।

এই ঐক্যের সঙ্গে জড়িত নেতারা বলেন, এবারও একটু বাধা আছে। তা হচ্ছে বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পুত্র মাহি বি চৌধুরী। বিএনপি সরকারে থাকার সময় খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তারেক ও মাহির। কিন্তু বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। উদ্যোক্তারা এ বাধাও দূর করতে কাজ করছেন।

বিএনপি মনে করে, সরকার যে মনোভাব নিয়ে এগোচ্ছে, তাতে বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমে চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এককভাবে বিএনপির পক্ষে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করা কঠিন এ বাস্তবতা দলের নেতারাও উপলব্ধি করছেন। এ লক্ষ্যে ড. কামালের গণফোরাম, বি চৌধুরীর বিকল্পধারা, আ স ম রবের জাসদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপির আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সময়ের প্রয়োজনে এখন সবাই রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার পক্ষে। আশা করি দ্রুতই এটি দৃশ্যমান হবে। সূত্র: আমাদের সময়