যশোর শিক্ষা বোর্ডে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

যশোর শিক্ষা বোর্ডে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে বোর্ডের সব কিছু চলছে চেয়ারম্যানের মর্জি মাফিক। মানা হচ্ছে না মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও ক্রয় নীতিমালা। উন্মুক্ত টেন্ডারের পরিবর্তে কৌশলে ছোট ছোট প্রকল্প দেখিয়ে কোটেশনে পছন্দের লোককে কাজ দিয়ে ফাঁয়দা লোটা হচ্ছে। গত আড়াই বছর ধরে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই চলছে এসব অনিয়ম।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলীম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে চলতি বছর বোর্ডের বিভিন্ন শাখায় ৪৫ জন মাস্টাররোল কর্মচারী নিয়োগ দেন। বোর্ডের কর্মচারী ইউনিয়নের কতিপয় নেতার যোগসাজসে প্রত্যেকের কাছ থেকে এক থেকে দেড় লাখ টাকা হারে ঘুষ নিয়ে এদেরকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ মাস্টাররোল এসব কর্মচারী নিয়োগের আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি নেয়ার প্রয়োজন থাকলেও বোর্ডের চেয়ারম্যান তা অমান্য করেছেন।
গত ২০১০ সালের ৫ আগস্ট এ সংক্রান্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা- ১০ থেকে শিক্ষাবোর্ড সমূহকে নির্দেশনা দিয়ে যে পত্র পাঠানো হয় এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। যার স্মারক নং- শিম/শাঃ ১০/১ (ছাড়পত্র)- ৭/২০০৮/৫৯৭।

পিপিআর আইন ২০০৮ লংঘন করে ছোট ছোট প্রকল্প দেখিয়ে কৌশলে কোটেশনে কোটি কোটি টাকার কাজ করা হচ্ছে। চেয়ারম্যানের অফিস রুম ও সভা কক্ষ মেরামত, নাম ফলক তৈরী এবং ফুল বাগান শোভা বর্ধনের নামে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। অথচ এসব কাজে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে বোর্ডের একাধিক সূত্র দাবি করেছে। এখাত থেকে একটি বড় অংকের টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে মালামাল কেনার নিয়ম থাকলেও ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে পিপিআর আইন ২০০৮ এর বিধি- ১৬ উপেক্ষা করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ছোট ছোট প্রকল্প দেখিয়ে কোটেশনে ৯ কোটি ২৭ লাখ ৮০ হাজার ২৩৫ টাকার মালামাল কেনা হয়েছে। এক্ষেত্রেও বড় ধরণের দুর্নীতি হয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে। অনুমোদনবিহীন এসব অনিয়মিত ব্যয় নিয়ে অডিট আপত্তি হলেও পরবর্তীতে বিশেষ ব্যবস্থায় তা নিম্পত্তি করা হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের মতো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান প্রধানের বার্ষিক ব্যয়ের ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা হলেও যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান ক্রয় ক্ষমতার অতিরিক্ত ১ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার ২৯১ টাকার মালামাল কিনেছেন কোটেশনের মাধ্যমে।

পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানী প্রদান সত্বেও পুনরায় বহিরাগত শ্রমিক দিয়ে একই কাজ করে অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে ৯ লাখ ৫২ হাজার ৬৩৫ টাকা। অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড অর্ডিন্যান্স ১৯৬১ এর অনুচ্ছেদ-১৩ (ই) এবং অস্টম জাতীয় সংসদের হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি ৪র্থ বৈঠকের সিদ্ধান্ত নং- ১০.১.৭ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ নং- শিম/শাঃ/ঃ১০/১(১৩)/২০০১ (অংশ)/৯১৫, তারিখ- ০৪/১০/২০১৭ অনুযায়ী কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ সম্মানী প্রাপ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সম্মানী ভাতা প্রদান করা সত্বেও একই কাজের জন্য বহিরাগত শ্রমিকদের পুনরায় পারিশ্রমিক প্রদান করার সিদ্ধান্ত ঐ আদেশের পরিপন্থী। গত ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে যোগদানের জন্য সিটিং এলাউন্স বাবদ ৫ হাজার ও টিএ/ডিএ বাবদ ৪ হাজার ২৫০ টাকা গ্রহণ করা সত্বেও চেয়ারম্যান পুনরায় ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর যশোর শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৭১৮০০১১৫৮ই নম্বর ভাউচারে ১২ হাজার ৮২ টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করেন। ঢাকাস্থ যশোর শিক্ষা বোর্ডের রেস্ট হাউজ সংস্কার করার জন্য ২০ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। রেস্ট হাউজের জন্য একটি এসি, দরজা, কিছু টাইলস্ ও কিছু চৌকি কিনে এই ২০ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। অথচ রেস্ট হাউজ সাঁজানোর জন্য সর্বোচ্চ ৭/৮ লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে বলে সূত্র দাবি করেছে। সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হলে এসব অভিযোগের প্রমাণ মেলবে বলে সূত্রের দাবি।
বয়স সংশোধনের ক্ষেত্রেও হয়েছে বড় ধরণের অনিয়ম। এসএসসি পাসের ছাত্র/ছাত্রীদের বয়স সংশোধনের ক্ষেত্রে ২ বছরের মধ্যে আবেদন করার নিয়ম থাকলেও বোর্ডের চেয়ারম্যান ২০১৭ সালে ১৫২ তম সভায় ৪ জন প্রার্থীর বয়স সংশোধনের ক্ষেত্রে এ নিয়ম লংঘন করেছেন। এসব প্রার্থীরা হলেন, এসএসসি, কেন্দ্রের নাম বরিশাল, রোল নং- ১০৭১৪৩, পাসের সাল ১৯৯৭, এসএসসি, কেন্দ্রের নাম কোটচাঁদপুর, রোল নং- ১৪৪, পাসের সাল ১৯৯২, এসএসসি, কেন্দ্রের নাম তেরখাদা, রোল নং- ২৫৪, পাসের সাল ১৯৯২, এসএসসি, কেন্দ্রের নাম চৌগাছা, রোল নং- ৮৫০৬০১ ও পাসের সাল ১৯৯৮।

গত আড়াই বছর ধরে সরকারী নীতিমালা উপেক্ষা করে চেয়ারম্যান বোর্ড কমিটির সভাসহ বিভিন্ন মিটিং এর নামে ভাতা বাবদ একটি বড় অংকের টাকা আত্মসাত করেছেন। অর্থাৎ নিজ অফিসে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বোর্ড থেকে এ ভাতা উত্তোলন করেন।

যশোর জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, চেয়ারম্যান নিজ অফিস ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে মিটিং করলে তিনি ভাতা প্রাপ্য হবেন, তবে যশোর শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে ওই অফিসে মিটিং করে যদি তিনি বৈঠকী ভাতা গ্রহণ করেন, তাহলে সেটা হবে অবৈধ। শিক্ষা বোর্ডে কোটেশনের মাধ্যমে এইচপি ১১০২ মডেলের প্রিন্টিারের টোনার কেনার ক্ষেত্রেও হয়েছে দুর্নীতি। এর প্রতিটির বাজার মূল্য ৮শ’ টাকা হলেও একটি টোনার কেনা হয়েছে ৪ হাজার টাকায়। অর্থাৎ ৬০টি টোনার কেনা হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা মূল্যে। এক্ষেত্রে সরকারের গচ্চা গেছে ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা। সাহিদ কম্পিউটার নামে যে প্রতিষ্ঠান থেকে টোনার কেনার কথা বলা হয়েছে বাজারে আদৌ তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এ খাত থেকেও লুটপাট করা হয়েছে বেশ টাকা।

এদিকে ২০১৫ সালের ২ জুলাই শিক্ষা বোর্ডে ৪২ লাখ টাকার হাই স্প্রিড কম্পিউটার ক্রয় নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে সর্বনিন্ম দ্বিতীয় দরদাতা যশোরের মাল্টি কম্পিউটার ল্যান্ডের মালিক আতাউর রহমান দুর্নীতির অভিযোগ এনে বোর্ডের তৎকালীন সচিব মোল্লা আমীর হোসেনের বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারী বিজ্ঞ আদালত এ মামলার রায় দেন। যার রায় নং- ২৫/১৯। রায়ে সচিব নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং বাদি আতাউর রহমান হেরে যান। অথচ বোর্ডের চেয়ারম্যান আদালতের নির্দেশনা না নিয়ে গত ১১ মার্চ সম্পূর্ণ অবৈধভাবে মাল্টি কম্পিউটার ল্যান্ডকে ওই কাজের অনুকূলে বিল পরিশোধ করেছেন। বোর্ডের স্কুল ও কলেজ অনুমোদন শাখাসহ গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলিতে অনিয়মের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলী করা হয়েছে। চেয়ারম্যান তাঁর মর্জি মাফিক পছন্দের লোকদেরকে এসব শাখায় বদলী করেছেন। যা নিয়ে বোর্ড অভ্যান্তরে কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলীমের সাথে মাস্টাররোল কর্মচারী নিয়োগসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়ে কথা বললে তিনি বলেন, আমার বোর্ডে যখন মাস্টাররোল কর্মচারী প্রয়োজন হবে, তখন তা আমি নিতে পারবো। এ বিষয়ে কারো অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। এছাড়া দুর্নীতি বিষয়ক আরও বেশকিছু প্রশ্ন করা হলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছেন বলে এসব প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান।