কৃষক হাশেম হত্যার আসামীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তারা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপরন্ত আসামীরা মামলা তুলে নিতে বাদী ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। পক্ষান্তরে পুলিশ মামলার আসামীদের আটক না করে মামলার বাদীকে সরে থাকার পরামর্শ দেওয়ায় বাদী প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ঘটনাটি ঘটেছে যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের ভাতুড়িয়া নারায়নপুর গ্রামে। এই গ্রামের খুনি নুরু মুহুরীর হুকুমে গত ১৫ জানুয়ারি তার পোষ্য ক্যাডাররা পিটিয়ে গুরুতর আহত করে কৃষক হাশেম আলী (৫৫) ও তার ছেলে আছর আলী (৩০) কে। ঘটনার পর দিন বিনা চিকিৎসায় নিজ বাড়িতে হাশেম আলী মারা যান।
এ ঘটনায় ২০ জানুয়ারি নিহতের স্ত্রী লিলিমা বেগম বাদী হয়ে হামলার হুকুমদাতা নুর ইসলাম ওরফে নুরু মুহুরীকে প্রধান আসামী করে ১৮ জনের নামে কোতয়ালী মডেল থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ সে বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পরবর্তীতে নিহতের ময়না তদন্তের রিপোর্ট প্রাপ্তি সাপেক্ষে বাদী ফের গত ২৯ এপ্রিল উক্ত আসামীদের নামে কোতয়ালী থানায় এজাহার দাখিল করলে পুলিশ তা হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করে। যার মামলা নম্বর ৫৮। ধারা – ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩০৭/৩০২/৪২৭/১১৪/৩৪ বাংলাদেশ পেনাল কোড।
মামলার বিবরণে জানা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি খেজুরের রস খাওয়াকে কেন্দ্র করে ভাতুড়িয়া গ্রামের কৃষক দিন মজুর হাশেম আলীর ছেলে আছর আলীকে নুরু মুহুরির নেতৃত্বে তার পোষ্য ক্যাডাররা বেধড়ক মারপিট করে। ছেলেকে রক্ষা করতে গেলে ওই সন্ত্রাসীরা কৃষক হাশেম আলীকেও ধারাল অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে। গুরুতর আহত পিতাপুত্রকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলে ওই সন্ত্রাসীরা তাদেরকে গ্রাম থেকে বের হতে না দিয়ে নিজ বাড়িতে আটকে রাখে। এক পর্যায়ে বিনা চিকিৎসায় পরদিন হাশেম আলী নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। খবর পেয়ে কোতয়ালী থানা পুলিশ লাশের সুরোতহাল রিপোর্ট তৈরী করে ও ময়না তদন্তের জন্য লাশ যশোর জেনারেল হাসপাতালে প্রেরণ করে। ১৭ জানুয়ারি যশোর জেনারেল হাসপাতালে লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। ২০ জানুয়ারি এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে যশোর কোতয়ালী মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে স্বামী হত্যার বিচার প্রার্থনা করে। অভিযোগে ভাতুড়িয়া গ্রামের সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান নুর ইসলাম ওরফে নুরু মুহুরীসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দীর্ঘদিন পুলিশ সেই অভিযোগটি আমলে না নিয়ে এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে গত এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে নিহতের স্ত্রী লিলিমা বেগম স্বামী হাশেম আলীর হত্যার ময়নাতদন্ত রিপোর্টটি হাতে পান। যেখানে স্পষ্ট ভাবে হাশেম আলীর মৃত্যুকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে বলা হয়েছে তাকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর ২০ এপ্রিল নিহতের স্ত্রী লিলিমা বেগম বাদী হয়ে ১৮জনকে অভিযুক্ত করে কোতয়ালী মডেল থানায় ফের একটি এজাহার দাখিল করেন। এবার কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুজ্জামান বাদীর এজাহারটিকে নিয়মিত মামলা আকারে গ্রহণ করেন।
মামলায় প্রধান আসামী ভাতুড়িয়া গ্রামের মৃত উসমান আলীর ছেলে নুর ইসলাম ওরফে নুরু মুহুরী। এছাড়া অন্য আসামীরা হচ্ছে একই গ্রামের আয়নাল আলীর ছেলে আব্দুল মান্নান, মৃত আকবার আলীর ছেলে মিন্টু, আবুল কাশেমের ছেলে কবিরুজ্জামান ওরফে কাজল, আব্দুস সামাদের ছেলে আতিয়ার ওরফে আতি খোকা, ওয়াজেদ ড্রাইভারের ছেলে আলামিন, মৃত লতিফ গাজীর ছেলে আহসান, নুর ইসলামের ছেলে ইসরাজুল, আব্দুল মান্নানের ছেলে বাপ্পী, মৃত উসমানের ছেলে ইউনুচ, হাশেম আলীর ছেলে রফিকুল, আব্দুস সালামের ছেলে রাজু, মফিজুর রহমান মিস্ত্রির ছেলে সোহেল, রবিউলের ছেলে ইমরান, মৃত ওমর আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর, রওশন আলীর ছেলে আব্দুল গফ্ফার ও ইনামুল পিতা অজ্ঞাত। কিন্তু পুলিশ হাশেম আলী হত্যার ঘটনায় মামলাটি রেকর্ড করলেও অদ্যাবধি কোন আসামীকে আটক করেনি।
মামলার বাদী বার বার আসামীদের আটকে থানা পুলিশের কাছে ধর্না দিলেও রহস্যজনক কারনে পুলিশ বাদীর আহবানে সাড়া দিচ্ছে না।
বাদী অভিযোগ করেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামীদের আটক না করে বরং তাকে নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
বাদী বলেন, “দারোগা তাকে এই মামলা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করার পরামর্শ দিয়েছেন। দারোগা বলেছেন, মামলায় যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তারা অর্থবিত্তের মালিক। তোমার তো বাড়ি ঘরও নেই। ওদের সাথে লড়াই করে তুমি পারবা না। বরং তুমি এখন একটু বুঝে শুনে চলবে। এই মামলায় কি হলো না হলো তা নিয়ে তুমি কারোর কাছে মুখ খুলবে না।”
বাদী অভিযোগ করেন, এই চাঁচড়া ভাতুড়িয়া নারায়নপুর গ্রামকে অশান্ত করে তুলেছে নুরু মুহুরী। তার বিশাল ক্যাডার বাহিনী ও অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থের কাছে সবাই জিম্মি হয়ে পড়েছে। তার ভয়ে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করার সাহস রাখে না। তারা টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করে। বিগত বিএনপি জামাতের সময় সরকারী দলের হয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে এই নুরু বাহিনীর ক্যাডাররা। শহরের শংকরপুর কেন্দ্রীক একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর শেল্টারে থেকে সে সময় নুরু মুহুরী ও তার ক্যাডাররা এই জনপদকে নরক বানিয়ে ফেলে। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে নুরু মুহুরী তার ভোল পাল্টে বর্তমান সরকারী দলের একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতার দলে নাম লিখিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান ভাবতে শুরু করে। রাতারাতি সে এই জনপদের দন্ডমুন্ডের কর্তা সেজে বসেছে। তার ওপর কথা বলার সাহস নেই কারোর। আর এই কারনে পুলিশ আমার স্বামীর খুনি নুরু মুহুরী ও তার পোষ্য ক্যাডারদের আটক না করে বরং আমাকে নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। যাতে করে মামলা নিয়ে আমি উচ্চ বাচ্য না করি।
এদিকে থানায় মামলা করায় নুরু গং লিলিমা বেগম ও তার ছেলেকে হত্যার হুমকি দিয়ে অবিলম্বে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। তাদের সাফ জবাব, মামলা তুলে না নিলে স্বামীর পথে তাকেও যেতে হবে। তার ছেলে আছর আলীকেও হত্যা করা হবে।
ফলে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে এখন নিজেই জীবনের শংকায় দিনাতিপাত করছেন লিলিমা বেগম। তিনি অবিলম্বে তার স্বামীর খুনি নুরু মুহুরীসহ সকল আসামীকে আটক ও শাস্তির দাবি জানান।