নুরু বাহিনীর চীফ কে এই নুরু ?

ভয়ঙ্কর জনপদ ভাতুড়িয়ার মাটি দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে নুরু বাহিনীর অর্ধশত ক্যাডার। তাদের ভয়ে টুশব্দটি করার উপায় নেই সাধারণ নির্যাতিত মানুষের। নিরবে চোখের পানিতে বুক ভাসলেও তাদের মুখে কথা বলার সাহস নেই। গ্রাম্য শালিস থেকে শুরু করে কোট কাচারী সব জায়গায় নুরু বাহিনীর ক্যাডারদের সরব উপস্থিতি। এসব ক্যাডাররা মুখে কথা বলার চেয়ে হাতের ও অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে বেশি পারদর্শি। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে সরকারী দলের ডাক সাইডের নেতাদের আর্শিবাদপুষ্ঠ হওয়ার কারনে এই বাহিনীর কোন কোন ক্যাডার আর তাদের গডফাদার রাজনৈতিক বাতাবরণে গা ভাষিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করছে। তাদের মুখের কথায় এই জনপদে আইন। তারা মানুষের জায়গাজমি বাড়িঘর দখল, জোর করে বাগানের গাছ কেটে নেওয়া, জমির ফসল কেটে নেওয়া, মাছের ঘের দখল করে নেওয়া, গরু ছাগল জবাই করে খাওয়া থেকে শুরু করে এহেন কোন অপরাধ কর্মকান্ড নেই যা এই বাহিনীর ক্যাডাররা করছে না।

কিন্তু অজ্ঞাত কারনে সেই আশির দশক থেকে তারা থাকছে ধরা ছোঁয়াই বাইরে। কোন কোন সময়, বিশেষ বাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে এই বাহিনীর গড ফাদার থেকে শুরু করে বেশ কিছু ক্যাডার আটক হলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে লিপ্ত হয় পূর্বের পেশায়। আর এই ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় শক্তি তাদের সংরক্ষিত অস্ত্র ভান্ডার। শহরের শংকরপুর কেন্দ্রীক হাসান বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ভাতুড়িয়ার লিটুর মাধ্যমে যে বিশাল অস্ত্র ভান্ডার গড়ে উঠেছিল বর্তমানে তা নুরু বাহিনীর ক্যাডারদের দখলে। ফলে এই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এই বাহিনীকে দিন দিন অপ্রতিরোধ্য করে তুলছে। ১/১১ সরকারের সময় হাসান বাহিনীর পতনের পর প্রাণ বাঁচাতে লিটু ও তার দেহরক্ষি কালা মিন্টু ও কসাই মান্নানকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। খবর আছে অর্থ বিত্তের ভাগাভাগি ও অস্ত্রের নিয়ন্ত্রনকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের শেষের দিকে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগোনায় লিটু খুন হয়। পরে কালা মিন্টু ও কসাই মান্নান সরকারী দলের স্থানীয় নেতাদের আর্শিবাদ নিয়ে এলাকায় ফিরে আসে। শুরু হয় তাদের পুরোনো পেশার নতুন রুপের ব্যবহার। আর এই বাহিনীর হাল ধরেন নুর ইসলাম ওরফে নুরু মহুরী।

এদিকে বর্তমানে পুলিশের চোখে ৩টি হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে নুরু পলাতক রয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও স্থানীয়রা বলছেন সে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার ক্যাডাররা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা এলাকা।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে যশোর কোতয়ালি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুজ্জামান বলেন, নুরুসহ তার ক্যাডারদের আটকে পুলিশের চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। তবে সে পলাতক রয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

এ দিকে হাশেম আলী হত্যা মামলার আইও ইন্সপেক্টর শাজাহান এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মামলঅর তদন্ত এগিয়ে চলছে আসামীরা তো আর পুলিশের হাতে ধরা দিতে বাড়িতে বসে থাকছে না। আমরা চেষ্টা করছি।
এছাড়া কামালসহ অন্যান্য মামলায় তাদের অনেকে সাজা প্রাপ্ত হয়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছে কেউ কেউ সাজা খেটেছে। তবে এদের হেফাজতে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্দারে পুলিশ সক্রিয়।

কে এই নুরুর মহুরী ?
ভাতুড়িয়া গ্রামের কৃষক পরিবারে নুর ইসলাম ওরফে নুরুর জন্ম। তার পিতা উসমান আলী ছিলেন পেশায় একজন কৃষক ও দিনমজুর। এক পর্যায়ে উসমান যশোর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে দলিল লেখকের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এই উসমানের ৩ ছেলের মধ্যে নুর ইসলাম মেঝ। অভাবের কারনে উসমান তার ছেলেদের লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। ফলে তারাও সবাই কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়। ব্যতিক্রম নুর ইসলাম। সুচতুর নুর ইসলাম ওরফে নুরু ৮ম শ্রেণীর গন্ডি পার না হলেও তার কেতাদূরন্ত ভাব তাকে জীবন বোধ সম্পর্কে নুতুন মাত্রা যুক্ত করে। নুর ইসলাম কৃষি কাজের পাশাপাশি বাপের হাত ধরে যশোর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে মহুরীর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। আর চাচাত ভাই লিটুকে ভিড়িয়ে দেয় শংকরপুর কেন্দ্রীক হাসান বাহিনীতে। অস্ত্র চালানোর দক্ষতা, বিশ^স্ততা ও দূরন্ত সাহসিকতার কারনে লিটু অল্প সময়ের মধ্যে হাসান বাহিনীর বিশ^স্ত একজন ক্যাডারে পরিণত হয়। অপরদিকে নুর ইসলাম ওরফে নুরু এই লিটুর পাওয়ার ও নাম ডাক ব্যবহার করে যশোর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে নিজস্ব বলয় তৈরী করে তার ভাগ্য বদলের খেলায় মেতে ওঠে। সরকারী বেসরকারী ও ব্যক্তিমালিকানাধিন জমি এহাত ওহাত করতে সিদ্ধ হস্ত নুরু ভাই লিটুর মাধ্যমে হাসান সিন্ডিকেটের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে তোলে। এক পর্যায়ে হাসানের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নুর ইসলাম ওরফে নুরু যশোর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে পিয়ন পদের চাকরি বাগিয়ে নেয়। ঘুরে যায় নুরুর ভাগ্যের চাকা। এ সময় হাসান বাহিনীর চীফ শংকরপুরের হাসান ও তার ভাই মিজানগং শহরের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে চাঁচড়া, ভাতুড়িয়া, নারায়নপুর, সুতিঘাটা, বলাডাঙ্গা, সাড়াপোল, উত্তর সাড়াপোল, নারায়নপুর, দাড়িপাড়া, বর্মণপাড়া, মদনপুর, বানিয়াবহু, মাহিদিয়া, করিচিয়া, তেতুলিয়া, কন্যাদহ, বাগেরহাট, রুদ্রপুরসহ গোটা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আর এই কাজে সিদ্ধ হস্ত লিটু ও নুরু হাসান গংকে সর্বত্র সাহাস্য সহযোগিতা করে তাদের বিশ^স্ত সেনাপতি হিসেবে চিহ্নিত হয়। লিটু হাসানের প্রধান দেহরক্ষি ও নুরু ক্যাশিয়ার হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে কাজ শুরু করে। আর এই বাহিনীর বিশ^স্ততাকে কাজে লাগিয়ে নুরু মহুরী নিজের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জীবিত অবস্থায় হাসান ও মিজান বহু সম্পত্তি গড়ে তোলে এই লিটু ও নুরুর নামে বেনামে। কিন্তু ১/১১ সরকারের সময় র‌্যাবের ক্রস ফায়ারে হাসান মিজান দুই ভাই নিহত হলে তাদের সা¤্রাজ্যের হাল ধরেন লিটু ও নুরু। এক পর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে লিটু তার দেহরক্ষী কালা মিন্টু ও কসাই মান্নানকে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমালে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন পায় নুর ইসলাম ওরফে নুরু। সরকারী অফিসের পিয়ন হওয়ার কারনে নুরু থাকে ধরা ছোঁয়াই বাইরে। এই সুযোগে হাসান বাহিনীর এই অঞ্চলীয় ক্যাডারার প্রাণ বাঁচাতে নুরুর সাথে হাত মেলায়। তারা নুরুকে তাদের লিডার মেনে তার নেতৃত্বে কাজ করতে থাকে। পরিবেশ পরিস্থিতি প্রতিকুলে থাকায় প্রথম দিকে এসব ক্যাডাররা কিছুটা নিরবে থাকলেও সময়ের সাথে সাথে সরকারী দলের ছত্রছায়ায় তারা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আর্বিভূত হয় পুর্বের রুপে। গোটা এলাকায় সৃষ্টি করে ত্রাসের রাজত্ব। শুরু হয় অস্ত্রের ভাষায় কথা বলা। আর তাদের গডফাদার হিসেবে সব কিছু ‘ম্যানেজ’ করার দায়িত্ব নেন নুর ইসলাম ওরফে নুরু মহুরী। তার আশ্রয়ে থেকে এই ক্যাডাররা ফের খুন খারাবিতে সক্রিয হয়ে ওঠে। নুরুর নির্দেশে এসব ক্যাডারদের হাতেই ভাতুড়িয়া গ্রামের আলতাফ, মাহিদিয়ার কাংগাল জলিল, সুতিঘাটার লাবলু, পিডিবির গাড়ি চালক মতিয়ার, চাঁচাড়ার রাষ্ট্রীয় পদক প্রাপ্ত মৎস্য ব্যবসায়ী কামাল, ভাতুড়িয়ার হাশেম আলীসহ একাধিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এসব হত্যাকান্ডের পাশাপাশি অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে নুরু সিন্ডিকেটের প্রধান নুরু কোটি কোটি টাকার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক বনে গেছে। তার এই অবৈধ অর্থ বিত্ত ও অস্ত্রের উৎস খুঁজতে বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা নুরু মহুরীকে বিপুল পরিমান ঘুষের টাকাসহ একবার আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করলেও অজ্ঞাত ক্ষমতার জোরে সে কারামুক্ত হয়ে ফিরে যায় পূর্বের পেশায়। নেতৃত্ব দিয়ে ক্যাডারদের ফের সক্রিয় করে তোলে মানুষ খুন, মাদক আর অস্ত্রের ব্যবসায়।