আনুগত্যের নিয়োগ আমলার প্রাধান্য

রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুলনামূলক স্বাধীনচেতা যোগ্য মানুষের বদলে দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিদের নিয়োগের সমালোচনা আছে নাগরিক সমাজে। এরূপ নিয়োগের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো জনস্বার্থ রক্ষার প্রহরী হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানটি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারছে না।

তেমনি মানবাধিকার কমিশন, প্রধান হিসাব নিরীক্ষকের অফিস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানও ম্রিয়মাণ। সাংবিধানিক বিধিবিধান ও উপযুক্ত পদ্ধতি উপেক্ষা করে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিয়োগ দিতে চান বলে বিশষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। সংবিধানে থাকলেও নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন করতে ৫০ বছর লেগেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভারসাম্যপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেসব চেয়ারে বসে সরকারকে প্রশ্ন করতে হবে, সেসব প্রতিষ্ঠানে আনুগত্যের নিয়োগ প্রাধান্য পাচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার।

বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সুস্পষ্ট আইন অনুসরণ করে, কোথাও পৃথক কমিশন গঠনের মাধ্যমে বা গণশুনানি করে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে নিয়োগ পাচ্ছেন দলীয় লেজুড় মনোভাবাপন্ন সাবেক আমলারা। তাই যেসব চেয়ারে বসে সরকারকে প্রশ্নে জর্জরিত করার কথা, সেখানে আনুগত্যের সুর বাজে।

পর্যবেক্ষকদের অভিমত, ব্যক্তির মতাদর্শগত অবস্থান থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেওয়ার পর দলের ঊর্ধ্বে উঠে যাঁরা তা পালন করতে পারবেন, তাঁদেরই নিয়োগ দেওয়া উচিত। সে রকম সাবেক আমলা দেশে আছেন, কিন্তু তাঁরা নিয়োগ পান না।

অভিমত জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান সমকালকে বলেন, সাংবিধানিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে মেরুদণ্ডওয়ালা লোক নিয়োগ দিতে হয়। কিন্তু গত কয়েকটি সরকারের আমল থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন লোকজন নিয়োগ পাচ্ছেন, যাঁরা তাঁদের চাকরিজীবনে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে উত্তীর্ণ। তাঁরা জনপ্রত্যাশার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেলে সেগুলো কোমরভাঙা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পায়।

বদিউর রহমান বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ড. মিজানুর রহমানের পর যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা কী করছেন? প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে আছে নাকি নেই- বোঝা যায় না। তাঁরা সরকারকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন না। নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সার্চ কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করল, সেটা জাতি জানতে পারল না। তাহলে স্বচ্ছতা থাকল কোথায়? যে নিয়োগে স্বচ্ছতা নেই, তাঁদের কাজে কীভাবে স্বচ্ছতা আসবে?

নির্বাচন কমিশন: সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ অর্থাৎ সংবিধানে নির্বাচন কমিশন বিষয়ে ৫০ বছর আগে আইন প্রণয়নের কথা বলা হলেও আইন হয়েছে সম্প্রতি। প্রণীত আইনের অধীনে গঠিত প্রথম নির্বাচন কমিশনও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারছে না। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথাগতভাবে যেভাবে নিয়োগ হতো, আইনে সেই ফরম্যাটই রাখা হয়েছে। একটি সার্চ কমিটি। সঠিকভাবে আইন না থাকায় নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়োগের কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। যাঁরা সারাজীবন সরকারি কর্মচারী হিসেবে আদেশ পালন করে অভ্যস্ত, তাঁদের দ্বারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা কঠিন বিষয়।

তিনি বলেন, প্রশ্ন তুলতে পারবেন এমন সাবেক আমলা নেই, বিষয়টি তা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, যাঁরা প্রশ্ন তুলতে পারবেন, তাঁরা নিয়োগ পান না; পেলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন অবস্থা হতো না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন পরিচালনার ক্ষেত্রে সাবেক বিচারপতিদের প্রাধান্য ছিল। আড়াই দশকের বেশি সময় নির্বাচন কমিশন পরিচালনায় সাবেক সচিবদের প্রাধান্য এসেছে। সাম্প্রতিক অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও কে এম নূরুল হুদা কমিশন, বিএনপি সরকার আমলের এম এ আজিজ কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম মানুষের মুখে মুখে ফেরে। গত ৫০ বছরে সিইসি পদে দায়িত্ব পালনকারী ১৩ জনের মধ্যে সাতজন বিচারপতি ও ছয়জন প্রশাসনের কর্মকর্তা। ১৯৯৬ সাল থেকে সিইসি পদে সাবেক সচিবদের নিয়োগ শুরু হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে দলীয় আনুগত্যের নিয়োগ হচ্ছে- এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। রাজনৈতিক মতাদর্শ যে কারও থাকতে পারে। কিন্তু যিনি শপথ নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বসবেন, তিনি তো জনস্বার্থ দেখবেন।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শীর্ষ পর্যায়ে রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সে দেশে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে গণশুনানি হয়।

সমকালের কলকাতা প্রতিনিধি শুভজিৎ পুততুন্ডু জানিয়েছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন প্রথাগত পদ্ধতিতে নিযুক্ত হয়। এতে সাবেক আমলাদেরই নেতৃত্ব দেওয়ার রীতি চলে আসছে। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। এটা ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের সৌন্দর্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর থাকলে জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার পায়। পেশাজীবী বা আমলা কে নিয়োগ পেলেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যিনি দায়িত্ব পেলেন, তিনি জনস্বার্থকে সমুন্নত রেখে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করতে পারলেন কিনা, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন: অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান থাকার সময় সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে মৌলিক পদক্ষেপ না নিতে পারলেও কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে গণমাধ্যমে তাঁর কথা গুরুত্ব পেত। এর পর থেকে মানবাধিকার কমিশনে নিয়োগ পেয়ে আসছেন সাবেক সচিবরা। গুম-খুনের মতো বড় ঘটনায় ড. মিজান সোচ্চার থাকলেও এসব বিষয়ে পরবর্তী কমিশনের দায়িত্বশীলদের কণ্ঠ শোনা যায় না।

সিএজি: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ হিসাব নিরীক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের অফিস’ (সিএজি) সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারি প্রতিটি টাকার হিসাব দিয়ে খরচ উত্তোলন করতে হয়। এখান থেকেই সরকারি খরচে দুর্নীতি-অপব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন ওঠার কথা, কিন্তু সে ধরনের প্রশ্ন কালেভদ্রেও ওঠে না। ‘অডিট আপত্তি’ নমনীয়ভাবে উঠলেও প্রতিকারের আদৌ নজির নেই, প্রায়শ সমঝোতায় পার পেয়ে যায়। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক একজন সচিব। এ খাতের অনেক ভালো ভালো ক্যাডার অফিসারের যোগ্যতা থাকলেও সিএজি পদে নিয়োগ পান না।

একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসারদের (সিএও) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন এমন ব্যক্তিকে কোনো সরকারই সিএজি হিসেবে নিয়োগ দেয় না। সচিব হিসেবে আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা নিয়োগ পান।

বিইআরসি: এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক ভূমি সচিব আবদুল জলিল। জ্বালানি-সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিইআরসির শুনানি গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্ব। এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ জ্বালানি খাতে জনস্বার্থ নিশ্চিত করা। অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেলের দামও বিইআরসির সুপারিশ অনুযায়ী হওয়ার কথা। গত শুক্রবার রাতে নজিরবিহীন অঙ্কে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে। বিইআরসির পক্ষ থেকে সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়ে টুঁ শব্দটিও নেই।

অন্যান্য: রাষ্ট্রের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সাবেক আমলাদের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যেসব ক্ষেত্রে একসময় পেশাজীবীদের প্রাধান্য দেওয়া হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে একজন সাবেক সচিব একাধিক মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নেওয়ার পর সদ্য আরেকজন সাবেক সচিব নিয়োগ পেয়েছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান পদেও ধারাবাহিকভাবে সাবেক সচিবরা নিয়োগ পাচ্ছেন।

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান হিসেবেও এখন আছেন সাবেক একজন সচিব। তিনি সুনামের অধিকারী। তবে লক্ষণীয়ভাবে পিএসসির ১৩ সদস্যের বেশিরভাগই সাবেক আমলা।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান, বিমান বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যানসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাবেক আমলারা নিয়োগ পেয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার সমকালকে বলেন, আমলাদের নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা রাজনীতিকরা ক্রমে হারিয়ে ফেলছেন।