তদন্ত থমকে গেল দুদকে

জাভেদ এ মতিন হংকংভিত্তিক মিং গ্লোবাল লিমিটেড নামে এক কোম্পানির কাছ থেকে প্রতারণা করে ১ কোটি ৩৩ লাখ ২৮ হাজার ৮০৩ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

বিনিয়োগ নেওয়ার নাম করে এ অর্থ নেন তিনি ২০২০ সালের জুন থেকে নভেম্বর সময়ে। একই সময়ে ওই অর্থের পুরোটা বাংলাদেশসহ অন্যত্র পাচার করেন।

এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করেছে মিং গ্লোবাল। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী। দুদক সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগ গুরুতর ও সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক হওয়ায় সংস্থাটি উপপরিচালক রফিকুজ্জামান রুমিকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়। তার পরে আর কোনো অগ্রগতি নেই।
জাভেদের প্রতারণায় অর্থ খোয়ানো ভুক্তভোগী হংকংভিত্তিক কোম্পানি মিং গ্লোবাল লিমিটেডের পরিচালক জ্যাক হেজ অস্ট্রেলীয় নাগরিক। গত বছরের ২০ জুলাই দুদকে তাঁর দেওয়া অভিযোগপত্রটি সংগ্রহ করেছে সমকাল।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মিং গ্লোবালের অর্থ জাভেদ যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর মালিকানাধীন মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশন নামে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউএস এসইসির ওয়েবসাইটে পাওয়া অপর এক তথ্যে জানা গেছে, সংস্থাটি সংশ্নিষ্ট সবাইকে এক সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, জাভেদের এ কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত নয়।
মিং গ্লোবালের পরিচালকের করা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে গড়া মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে জাভেদ পাচার করে এ অর্থ এনে বাংলাদেশে মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড নামে কোম্পানি খুলেছেন, যে কোম্পানিতে তাঁর পার্টনার বিতর্কিত সরকারি কর্মকর্তা সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরো এবং দেশের ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান। হিরোর সঙ্গে তাঁর শেয়ার ব্যবসায় কারসাজিমূলক লেনদেনের আলামত আছে, যার কিছু নথি সমকালের কাছে রয়েছে।
অভিযোগপত্রে জ্যাক হেজ বলেছেন, জাভেদ মতিন তাঁর থেকে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া ১ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের বেশি অঙ্ক থেকে ৯ লাখ ১৪ হাজার ৬৮৫ ডলার বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন, যার উল্লেখযোগ্য অংশ জমা হয়েছে বাংলাদেশের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, যিনি গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা। অর্থ জমা হয়েছে কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে। জ্যাক হেজ জানিয়েছেন, এ কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় জাভেদ বাংলাদেশে এ টাকা পাচার করে আনতে পেরেছেন। এ কারণে অভিযোগপত্রে ওই কর্মকর্তাকে এক নম্বরে রেখেছেন তিনি।

জ্যাক হেজের অভিযোগ, ২০২০ সালের ২৯ জুন থেকে ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯২৪ ডলার, জিন বাংলা ফেব্রিক্সের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৩ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত মোট ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮২ ডলার পাঠিয়েছেন। এর বাইরে ইস্টার্ন ব্যাংকের মালিকানাধীন ইবিএল সিকিউরিটিজে একই বছরের ১৯ জুন ৭৩ হাজার ৩৫৯ ডলার পাঠান।
জ্যাক হেজ তাঁর অভিযোগপত্রে জিন বাংলা ফেব্রিক্সের স্বত্বাধিকারী হিসেবে আরিফুল ইসলামের নাম উল্লেখ করেছেন। তবে সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ কোম্পানিটির মূল উদ্যোক্তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উক্ত শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা। যৌথ মূলধনি কোম্পানির নিবন্ধক কার্যালয় আরজেএসসিতে এ কোম্পানির নিবন্ধনের কোনো রেকর্ড নেই। বর্তমানে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর ওয়েবসাইটে এ কোম্পানিসংশ্নিষ্ট তথ্যে আরিফুল ইসলামের নাম আছে। তবে সুইজারল্যান্ড-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নথি অনুসারে, এক সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওই কর্মকর্তা জিন বাংলা ফেব্রিক্সের হয়ে কর্মকর্তা চেম্বারের সদস্য ছিলেন। জিন বাংলার ব্যবসায়িক কার্যক্রম ২০১৬ সালের পর থেকে বন্ধ- এ তথ্য শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তাই সমকালকে জানিয়েছেন। এখন এ কোম্পানির স্বত্বাধিকারী হিসেবে যে আরিফুল ইসলামের নাম রয়েছে, তিনি সম্পর্কে তাঁর চাচা।

প্রতারণার কলাকৌশল :জাভেদ এ মতিন কীভাবে প্রতারণা করে কোটি ডলার হাতিয়েছেন; দুদককে দেওয়া অভিযোগপত্রে মিং গ্লোবালের পরিচালক জ্যাক হেজ তা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, ২০২০ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের এক প্রতিনিধি হংকংয়ের ফার্স্ট ইস্টার্ন ইনভেস্টমেন্টের এজেন্ট পরিচয় দিয়ে হংকংয়েরই একটি মোবাইল নম্বর (+৮৫২-৩০০২-৪৪৩০) থেকে কল করে বিনিয়োগের প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাবে বিশ্বাস করে প্রথমে ২০ হাজার ডলার বিনিয়োগে রাজি হয় মিং গ্লোবাল। ওই অর্থ মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের ব্যাংক অব আমেরিকার অ্যাকাউন্টে পাঠায়। মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের মিথ্যা ও চাতুর্যপূর্ণ উপস্থাপনাকে সত্য ধরে ২০২০ সালের ৫ জুন থেকে ১৮ আগস্টের মধ্যে আরও ১ কোটি ৩৩ লাখ ৮ হাজার ৮০৩ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা জাভেদকে দেওয়া হয়।
ব্যাংক অব আমেরিকা এবং ইউএস ব্যাংক নামক যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্যাংকে মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের যে দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মিং গ্লোবাল অর্থ পাঠিয়েছিল, তা পরিচালনা করতেন জাভেদ এ মতিন এবং তাঁর বান্ধবী ফিলিপাইনের নাগরিক মারিয়া ভেরোনিকা সো। কিন্তু অর্থ নেওয়ার পর উভয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

এর পর প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট আদালতে জাভেদ ও তাঁর বান্ধবী এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের আগস্টে মামলা করে মিং গ্লোবাল। আদালতের আদেশে পাওয়া ওই দুই ব্যাংকের স্টেটমেন্ট ও সিগনেচার কার্ড থেকে জানা যায়, ইউএস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জাভেদ এ মতিন নিজেকে মোনার্ক হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের অনুমোদিত প্রতিনিধি এবং ব্যাংক অব আমেরিকায় অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নিজেকে সিএফও হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন।

এ মামলা করার আগেই জাভেদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পলাতক। ভুক্তভোগী মিং গ্লোবালের পরিচালক জ্যাক হেজ অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে জাভেদের অবস্থান শনাক্ত করেন। এর পর ওই সংস্থা এবং বাংলাদেশের এক আইনজীবীর মাধ্যমে শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা, তাঁর চাচা আরিফুল ইসলাম এবং ইবিএল সিকিউরিটিজের কাছ থেকে অর্থ ফেরত চেয়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যোগাযোগ করেন।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা নিজের সম্মান ও পদ হারানোর ভয়ে নতুন গল্প ফেঁদে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। মিং গ্লোবালের পক্ষ থেকে টাকা চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠানোর পর অর্থ ফেরত না দিয়ে প্রকৃত দাবিদারকে নির্দিষ্ট করার আবেদন জানিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে নিজে থেকে ঢাকায় বিচারক শাম্মী আখতারের তৃতীয় যুগ্ম জজ আদালতে ইন্টারপ্লিডার সু করেন।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা জাভেদের যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকাউন্ট থেকে ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। এ টাকা গ্রহণের কারণ হিসেবে জাভেদের যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিকে কারখানা স্থাপনের জন্য ফ্লোর স্পেস ভাড়া দেওয়া বাবদ অগ্রিম ১ কোটি ৮০ লাখ নিয়েছেন বলে জানান।

তবে তৃতীয় পক্ষের (মিং গ্লোবাল) ওই অর্থের মালিকানা দাবি করায় তিনি গ্রহণ করা অর্থ থেকে ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নানা খরচ বাবদ কেটে রেখে বাকি ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা প্রদানেরও আবেদন করেন।