সিলেটের গৌরব কৈলাশ টিলা ও মাজার

সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানা দীর্ঘ দুই শতাব্দী ধরে তার নিজস্বতা, ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধির জন্য পরিচিত। শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রণী এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো কৈলাশ টিলা। এটি কেবল একটি তেল ও গ্যাসক্ষেত্রই নয়, বরং আধ্যাত্মিক সাধক হযরত কৈলাশ শাহ (রহ.)-এর মাজারকে কেন্দ্র করে এটি এক পবিত্র স্থানে পরিণত হয়েছে, যা গোলাপগঞ্জবাসীর জন্য এক গর্বের বিষয়।

প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব:

গোলাপগঞ্জ থানা, বিশেষ করে কৈলাশ টিলা, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এখানে আবিষ্কৃত তেল ও গ্যাসের অফুরন্ত ভাণ্ডার বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। কৈলাশ টিলা গ্যাস ফিল্ড ১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত হয় এবং ১৯৮৩ সাল থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাস সারা দেশে শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করছে। এছাড়াও, এখানে খনিজ তেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা আরও বাড়িয়ে তুলবে।

কৈলাশ টিলা তৈল মূল্যায়ন, গ্যাস উন্নয়ন (কূপ নং-৪) প্রকল্প: এই প্রকল্পটি কৈলাশ টিলার তেল মজুদ পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য হাতে নেওয়া হয়েছে। সফল বাস্তবায়ন হলে এই কূপ থেকে প্রতিদিন ৫৫০ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম তেল উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে। যদি বাণিজ্যিক তেল না পাওয়া যায়, তবে কূপটি থেকে প্রতিদিন ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং ৩০০ ব্যারেলের বেশি উপজাত তেল (NGL) উৎপাদিত হবে। এই প্রকল্পটি সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।

আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য:

কৈলাশ টিলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো আধ্যাত্মিক সাধক হযরত কৈলাশ শাহ (রহ.)-এর মাজার। এই টিলাতেই তাঁর মাজার অবস্থিত, যা প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সমাগম ঘটায়। সিলেটের মাটি ও সিলেটের কথা সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থ এবং হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সিলেট বিজয় নিয়ে রচিত গ্রন্থগুলোতে এই সাধক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। আধ্যাত্মিক এই গুরুত্বের কারণে কৈলাশ টিলা লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নবাসীর কাছে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

সিলেট বিভাগের খনিজ সম্পদ:

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড ১৯৫৫ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল আবিষ্কার ও উৎপাদনে পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে সিলেট বিভাগের চার জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের সর্বপ্রথম গ্যাসক্ষেত্র ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে আবিষ্কৃত হয়, যা ১ নং কূপ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জের টেংরাটিলায় (ছাতক কূপ ১ নং) এবং বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।

বর্তমান পরিস্থিতি:

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের আওতায় বর্তমানে ছয়টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে: হরিপুর, কৈলাশ টিলা, রশিদপুর, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং ছাতক। এই ক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক গড়ে ১৪০ মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফুট (MSCF) পরিশোধিত গ্যাস এবং প্রায় ৮০০ ব্যারেল কনডেনসেট উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত গ্যাস তিতাস ও জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেমে সরবরাহ করা হয় এবং কনডেনসেট থেকে পেট্রোল, ডিজেল, আইকেও এবং অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করা হয়।

স্থানীয় জনগণের বঞ্চনা ও দাবি:

গোলাপগঞ্জবাসী কৈলাশ টিলার তেল ও গ্যাস নিয়ে গর্ব করলেও তাদের মধ্যে এক ধরনের দুঃখ ও বঞ্চনা রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরিত হয়, সেখানে স্থানীয় জনগণ তার ন্যায্য হিস্যা পেয়ে থাকে। কিন্তু গোলাপগঞ্জের তেল ও গ্যাস সারা দেশে ব্যবহৃত হলেও স্থানীয় মানুষজন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এই বঞ্চনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। কৈলাশ টিলায় তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই জনগণ তাদের ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে এবং সংসদেও বহুবার এই দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু ফলপ্রসূ কিছু হয়নি।

সিলেট বিভাগের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের চিত্র:

১৯৯৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড কর্তৃক আহরিত প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ নিচে তুলে ধরা হলো:

হরিপুর গ্যাসক্ষেত্র: মোট মজুদ গ্যাস ৪৪৪ বিলিয়ন ঘনফুট, উত্তোলনযোগ্য মজুদ ২৬৬ বিলিয়ন ঘনফুট। ১৯৯৬ সালের জুন পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ১৫৭.২৯৫ বিলিয়ন ঘনফুট, অবশিষ্ট উত্তোলনযোগ্য মজুদ ১০৮.৭০৫ বিলিয়ন ঘনফুট।

কৈলাশ টিলা গ্যাসক্ষেত্র: মোট মজুদ ৩,৬০০ বিলিয়ন ঘনফুট, উত্তোলনযোগ্য ২,৫২৯ বিলিয়ন ঘনফুট। উত্তোলন করা হয়েছে ৯৯.৭৬ বিলিয়ন ঘনফুট, অবশিষ্ট ২,৪২০.৯২৪ বিলিয়ন ঘনফুট।রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র: মোট মজুদ ২,২৪২ বিলিয়ন ঘনফুট, উত্তোলনযোগ্য ১,৩০৯ বিলিয়ন ঘনফুট। উত্তোলন করা হয়েছে ৬৬.৪৫৪ বিলিয়ন ঘনফুট, অবশিষ্ট ১,১০০.৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট।বিয়ানীবাজার গ্যাসক্ষেত্র: উত্তোলনযোগ্য ১১৪ বিলিয়ন ঘনফুট, তবে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়নি।

ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র: মোট মজুদ ৩৫০ বিলিয়ন ঘনফুট, উত্তোলনযোগ্য ২১০ বিলিয়ন ঘনফুট, অবশিষ্ট ১,১৩.৫৩৫ বিলিয়ন ঘনফুট।ছাতক গ্যাসক্ষেত্র: একটি মাত্র কূপের উৎপাদন ১৯৯৮ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে।
তেল উৎপাদন: সিলেটের একমাত্র হরিপুর তেলক্ষেত্র থেকে তেল উৎপাদিত হতো। কূপ দিয়ে পানি আসার কারণে ১৯৯৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে তেল উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। হরিপুর তেলক্ষেত্রে মোট তেলের মজুদ (আনুমানিক) ৮.২০ মিলিয়ন ব্যারেল (অপরিশোধিত), উত্তোলনযোগ্য (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) ১.৫০ মিলিয়ন ব্যারেল। উত্তোলন করা হয়েছে ০.৫৬১ মিলিয়ন ব্যারেল।

আর্থিক মুনাফা: সিলেটের তেল ও গ্যাস কূপগুলো থেকে ১৯৯০-৯১ সালে মোট মুনাফা (গ্রস) ছিল ১৪ কোটি ৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা। পরবর্তীতে এই অঙ্ক বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৪-৯৫ সালে ২৩ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকায় দাঁড়ায়।

এই পরিসংখ্যানগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে সিলেট বিভাগ থেকে কী পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরিত হয় এবং এর আর্থিক মূল্য কত। একই সাথে, স্থানীয় জনগণের ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়।

ভবিষ্যতের ভাবনা:


কৈলাশ টিলা কেবল গোলাপগঞ্জবাসীর গর্ব নয়, এটি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এর আধ্যাত্মিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব উভয়ই অপরিসীম। তবে, স্থানীয় জনগণের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং ন্যায্য হিস্যার দাবি পূরণের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছে, তেমনি স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও এর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হওয়া উচিত।