অ্যাথলেটিক্সে কি সুদিন ফিরবে?

রেকর্ডের স্থায়িত্বকালই বলে দেয় বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্সের জরাজীর্ণ অবস্থার কথা। গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়া জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে ৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙেছিলেন সেনাবাহিনীর নাজমুল হোসেন রনি। ৫০.৮৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে ১৯৯৩ সালের রেকর্ড ভেঙে দেন তিনি। ৫১.৮৭ সেকেন্ডে ওই রেকর্ড গড়েছিলেন নৌবাহিনীর আবদুর রহিম।

এবার মেয়েদের ৪০০ মিটার হার্ডলসে নতুন রেকর্ডের রানি হয়েছেন সেনাবাহিনীর বর্ষা খাতুন। এক মিনিট ০৪.৬১ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন তিনি। এর আগে ২০২২ সালে এক মিনিট ০৪.৭০ সেকেন্ডে রেকর্ডের মালকিন ছিলেন একই দলের লিবিয়া খাতুন। শাহ আলম, বিমল তরফদার কিংবা প্রয়াত মাহবুবদের উত্তরসূরিদের মাঝে দেখা যাচ্ছে না নতুন শাহ আলমদের ছিটেফোঁটাও।

পোলভল্ট (পুরুষ) ইভেন্টে এবার নতুন জাতীয় রেকর্ড গড়েন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মো. সৌরভ মিয়া ৪.৫০ মিটার লাফিয়ে। ১৯ বছর আগে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হুমায়ুন কবিরের রেকর্ড ছিল ৪.৩৫ মিটার। ৪›৪০০ মিটার রিলে (মহিলা) ইভেন্টে ৩১ বছর পরে নতুন জাতীয় রেকর্ড গড়েন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শিরিন আক্তার, সাবিহা আল সোহা, নুসরাত জাহান রুনা ও নাথেরা খাতুন। সময় নিয়েছেন ৩:৫১.৬২ সে.। ১৯৯৩ সালে বিজেএমসির নাছিমা, সুবনা, মনিয়া ও সুমিতার রেকর্ড ছিল ৩:৫৫.৫৫ সে.।

আশার কোনো খবর নেই স্প্রিন্টে। জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে সেই পুরোনো মুখ। ইমরানুর না থাকায় তিন বছর পর দেশের দ্রুততম মানবের মুকুট পুনরুদ্ধার করেন মো. ইসমাইল। তার টাইমিং ১০.৬১ সেকেন্ড (ইলেকট্রনিক্স)। এ নিয়ে পঞ্চমবার এই খেতাব জেতেন তিনি।

অন্যদিকে দ্রুততম মানবীর মুকুট অক্ষুন্ন রাখেন শিরিন আক্তার। টানা ১৬ বার দেশের মেয়েদের মধ্যে সেরা অ্যাথলেট হলেন। তার টাইমিং ১২.০১ সেকেন্ড (ইলেকট্রনিক্স)।

শিরিনের বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি দেশে। যেখানে তার টাইমিং ১২.০১ সেকেন্ড, সেখানে তার সতীর্থ সুমাইয়া দেওয়ানের টাইমিং ১২.১৫ সেকেন্ড। ১৪ মাইক্রো সেকেন্ড পেছনে। শিরিন আক্তার ১৬ বছর ট্র্যাকে পার করে দিয়েছেন, কোথায় গিয়ে থামবেন জানেন না। তার কথা, ‘থামব কেন? আমি তো এখনো চ্যাম্পিয়ন হই। নতুন কেউ আমাকে হারাতে না পারলে আমার করার কী আছে। আমার একটাই আশা আমি আন্তর্জাতিক আসরে একটি স্বর্ণপদক এনে দিতে চাই দেশকে। তারপর অন্যকথা ভাবব।’ দীর্ঘদিন ধরে সেরা শিরিনের প্রতিপক্ষ কি এখনো তৈরি হয়নি? এমন প্রশ্নের উত্তরে শিরিনের কথা, ‘আসলে প্রতিপক্ষ তৈরি হয়নি তা আমি বলব না। কারণ ট্র্যাকে ন্যানো ও মাইক্রো সেকেন্ডে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। তাই দৌড়ানোর সময়েও চোখ খোলা রেখে সজাগ থাকতে হয়।’

আসলে শিরিনের করার কিছু নেই, বয়স তার গতি কমিয়ে দিলেও স্বর্ণতো কেড়ে নিতে পারছেন না অন্য কেউ। স্প্রিন্টের বর্তমান চিত্রকে প্রতীক ধরে পুরো অ্যাথলেটিকসের চিত্রটাই এঁকে নেওয়া যায়। সাফ গেমসে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। শাহ আলম, বিমল তরফদার, মাহবুবদের হাতে লাল-সবুজের পতাকা উড়েছে দেশে-বিদেশে। সেই পতাকা এখন নুইয়ে পড়েছে। ২০১০ সালে নিজেদের মাঠে এসএ গেমসেও সোনা জিততে পারেননি কোনো অ্যাথলেট। সর্বোচ্চ অর্জন ছিল হার্ডলার সুমিতার রুপা জয়। এতটা শ্রীহীন হয়ে যাওয়ার পরও টনক নড়েনি অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের।

১৯৮৬ সালের এশিয়ান গেমসে ৮০০ মিটার দৌড়ে পঞ্চম হয়েছিলেন সে সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশি দৌড়বিদ মিলজার হোসেন। ঢাকা স্টেডিয়ামের লাল ট্র্যাকের দিকে চেয়ে বিষণ্ন্ন হয়ে তিনি বললেন, ‘শুধু আমি কেন, সে সময় আমাদের খেলাধুলার অবস্থাই অন্য রকম ছিল। ছিয়াশি এশিয়ান গেমসে আমি ও শর্মিলা ৮০০ মিটার ফাইনালে দৌড়েছি। ডন, শাহ আলম ২০০ মিটার ও ১০০ মিটার সেমিফাইনালে দৌড়েছে। অ্যাথলেটিক্স বাদ দেন। বক্সিংয়ে ওই এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছে মোশাররফ। আজ এক ক্রিকেট ছাড়া কোনো খেলায় আমরা ফাইনালে যেতে পারি?’

কারণটা কী? নানা মত আছে। আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিবর্ণ অ্যাথলেটিক্স বিবর্ণতর হয়ে ওঠার প্রধান দুটি কারণ খুঁজে পাওয়া গেল। প্রথমত জীবিকার সংকট, দ্বিতীয়ত স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অ্যাথলেটিক্সে অনাগ্রহ। কাস্টমস, বিজেএমসি, বিটিএমসির মতো প্রতিষ্ঠান খেলাধুলা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে, এটাকেই বড় কারণ হিসাবে দেখাতে চাইলেন মিলজার। মিলজার শুধু বাংলাদেশের নয়, দেখেছেন খুলনা বিভাগের স্বর্ণযুগও।

যে দুই দশকজুড়ে খুলনা বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে আধিপত্য করেছে, তা দেখেছেন; দেখেছেন পতনও, ‘বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্সের পতনটা কেন, তা খুলনার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো থেকে যে অ্যাথলেটরা আসতেন, তারা তো আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছেন। একে একে বন্ধ হয়ে গেছে পাটকল, বস্ত্রকল। নতুন চাকরি দূরে থাক, যেসব অ্যাথলেট বিজেএমসি-বিটিএমসির চাকরিতে ছিল, তারা অনেকে কাজ হারিয়েছেন। মাঠে ধান কেটে এসে খালি পেটে অ্যাথলেটিক্স হয় না।’