হঠাৎ উত্থান ড. কামালের

হঠাৎ করেই দেশের রাজনীতিতে উত্থান ঘটেছে ড. কামাল হোসেনের। ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং মন্ত্রী-এমপিরা প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে পাশে ফেলে এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকে আক্রমন করছেন। কেউ তাঁর (ড.কামাল) বিরুদ্ধে বোমা ফাঁটানো তথ্য দিচ্ছেন, কেউ বিয়োদগার করছেন, কেউ কথার তীর ছুঁড়ে মারছেন।

হামলা-মামলা, গ্রেফতার, আদালতে দৌঁড়ঝাপে বিএনপির মেরুদন্ড বাঁকা হয়ে গেছে। তাদের রাস্তায় নামতে দেয়া দূরের কথা আইন শৃংখলা জনিত কারণ দেখিয়ে সভা সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ৯২ দিন অবরোধের পর বিএনপি কার্যত রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ‘ছুটি’ দিয়েছে। শহীদ জিয়ার মাজার জিয়ারত ছাড়া কোথাও নেই দলটি। কিন্তু কাজেকর্মে না থাকলেও বিএনপি কার্যত বছরজুড়ে সর্বত্রই ছিল উপস্থিত। আওয়ামী লীগের যত সভা সমাবেশ, কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যায়ে যত কর্মসূচি পালিত হয়েছে সেখানে বিএনপিকে আক্রমন করা হয়। দেশের উন্নয়ন থেকে শুরু করে সব বিষয়ে কথা বলার সময় মন্ত্রী, এমপি, দলের নেতা, সহযোগীয় সংগঠনের নেতারা বিএনপিকেই আক্রমন করে বক্তৃতা দেন। এমনকি জাতীয় সংসদে না থাকলেও বিএনপি নাম সবচেয়ে সংসদে মন্ত্রী-এমপিদের মুখে বেশি উচ্চারিত হয়। সংসদে গড় হাজির থেকেও বিএনপি নামটি থাকে সদা হাজির। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ক্ষমতাসীন দলের সভার আয়োজন করা হয়; সেখানেও বিএনপির নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়। বিনা খরচে প্রচারণা পায় দলটি। এখনো বিএনপিকে গালিগালাজ করা ক্ষমতাসীন দলটির নেতাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

বিএনপির ‘যায়গা’ হঠাৎ করে যেন ‘দখল’ করে নিলেন ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেতা ড. কামাল হোসেন। তার বিরুদ্ধেই এখন চলছে আওয়ামী লীগ নেতাদের ফ্রি ব্যাটিং। গত এক সপ্তাহে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে আক্রমণ করে যত না বক্তব্য দিয়েছেন; তার চেয়ে বেশি কথা বলছেন গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করে বলেছেন, ড. কামাল হোসেনরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করছেন। ড. কামাল সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে নিয়ে জুডিশিয়াল ক্যু’র চেষ্টাও করেছিল’।

গণফোরাম নেতা কামাল হোসেনের কঠোর সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ এমনকি ছাত্রলীগ নেতারা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে যখন শান্তিময় রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল, ঠিক সে সময় ১/১১-এর কুশীলবেরা আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অসম্ভব খেলায় মেতে উঠেছে। সবিনয়ে ড. কামাল হোসেনের কাছে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, গুন্ডাতন্ত্র কাকে বলে?

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, যখন দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ হয়, তখনই হঠাৎ তাঁর নড়াছড়া শুরু হয়। উনি (কামাল হোসেন) তখনই সরকারকে আক্রমণ করে বিভিন্ন কথা বলেন। এই শ্রেণির মানুষরাই সুযোগ সন্ধানী। তারা ভাবে যে যেকোন অস্থিতিশীল পরিবেশের মাধ্যমে তাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা পেতে পারে। সেই স্বপ্ন থেকেই তারা ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটে।

আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, ড. কামাল হোসেনের ভাষা আর গুন্ডাদের অ্যাকশনের ভাষার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখছি না। এটি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। কারণ, ড. কামাল হোসেনকে এতদিন একজন ভদ্র ব্যক্তি হিসেবেই জানতাম।

সম্প্রতি ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে অনুষ্ঠিত ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে ড. কামাল হোসেনের তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং তার সাম্প্রতিক আচরণকে সন্দেহজনক উল্লেখ করে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বানও জানানো হয়। ড. কামাল হোসেনের ‘দেশে গণতন্ত্র নয়; আছে গুন্ডাতন্ত্র’ ও ‘আমাকে গুলি করে মারা হোক’ বক্তব্যের প্রতি ১৪ দলের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ষড়যন্ত্র আজকে কোথায় গেছে, ড. কামাল হোসেন যিনি নিজেকে সিনিয়র সিটিজেন দাবি করেন, তিনি কীভাবে এমন বক্তব্য রাখেন। কামাল হোসেন গুন্ডাতন্ত্রের কথা বলে নিজেই গুন্ডামি করছেন। খালেদা জিয়ার রায়ের পর আমরা দেখেছি, ড. কামালের বাড়ির বারান্দায় বিএনপি নেতারা ঘুর ঘুর করছে। তখনই বলেছি এই বর্ণচোরা ড. কামাল ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মেলাবেন, তাই হয়েছে। ড. কামাল, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুররা এখন শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাকারী বিএনপি-জামায়াতের ভাষায় কথা বলে।

১৪ দল নেতারা বলেন, ড. বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় মার্শা ব্লম বার্নিকাট ও কামাল হোসেনের নৈশভোজের গোপনীয়তাই প্রমাণ করে এটি সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিল। ড. কামাল দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে গলা ফাটানো শুরু করেছেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, দেশের কয়েকজন নামকরা রাজনীতিবিদ কী কথা বলেছেন। উসকানিমূলক কথা বলেছেন। একজন মানুষ যখন ব্যর্থ হয় তখন তিনি আবোল-তাবোল কথা বলেন। একজন বলেছেন গুলি কর আমাকে। কে কাকে গুলি মারবে বলেন!

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘উনি (কামাল হোসেন) তো ১/১১ সময়েও তৃতীয় শক্তি আনার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এখন আবারও সেই প্রক্রিয়াই আছেন তিনি। একবার তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়েছেন। কামাল হোসেনদের সকল ষড়যন্ত্র আমরা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করব।

আওয়ামী লীগের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ড. কামাল হোসেন ’৮১ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছেন। ১৯৯১ সালে ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে’ বক্তব্য দিলে মূল নেতৃত্বের সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে। মুল নেতৃত্ব ওই নির্বাচনে ‘সুক্ষ্ন কারচুপির’ অভিযোগ তোলেন। এ সময় কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ছেড়ে গঠন করে গণতান্ত্রিক ফোরাম। ’৯৩ সালে দলের নাম থেকে ‘তান্ত্রিক’ শব্দ ফেলে দিয়ে গণফোরাম করেন। তখন থেকেই তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতির কথা বলে আসছেন। কখনো একাই আবার কখনো সাবেক প্রেসিডেন্ট বি চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত জনগণের ক্ষমতায়নের রাজনীতির পক্ষ্যে জনমত গঠনে সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন।

সুজন সম্পদকের বাসায় নৈশভোজের পর যেখানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর আক্রমন করা হয় সেই নৈশভোটে কামাল হোসেন আমন্ত্রিত ছিলেন। ৬ আগস্ট একটি অনুষ্ঠানে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, চলছে গুন্ডাতন্ত্র। এরপর থেকেই কামাল হোসেনের ওপর শুরু হয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের আক্রমন। এ যেন বিএনপির ভাগ্য বরণ করলেন কামাল হোসেন। কোথাও না থেকেও তিনিই আলোচনা-সামালোচনা-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। দীর্ঘ ৪ বছর থেকে কোথাও না থেকেও বিএনপি’র বিচরণ যেন সর্বত্র। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা ২০টি কথা বললে ১৫টিতেই বিএনপির বিয়োদগার করেন। না চাইতেই ‘বিএনপি প্রচারণা পায়’। তেমনি ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথামালার বদৌলতে এখন কামাল হোসেন প্রচারণা পাচ্ছেন। দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই যেন ড. কামাল হোসেনের উত্থান ঘটলো। ক্ষমতাসীনরা সবখানেই তাকে নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সূত্র: ইনকিলাব