রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ‘প্রস্তুত’ বলে মিয়ানমার দাবি করে এলেও বাস্তবে রাখাইনের রোহিঙ্গা গ্রামগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে পুলিশ ব্যারাক ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে বলে উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
মিয়ানমার সরকারের ব্যবস্থাপনায় কয়েক দিন আগে বিদেশি সাংবাদিকদের একটি দলকে উত্তর রাখাইনের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিবেদক জোনাথন হেড।
তিনি সেখানে অন্তত চারটি জায়গায় নতুন গড়ে তোলা নিরাপত্তা স্থাপনা দেখেছেন, যেসব জায়গায় এক সময় রোহিঙ্গাদের গ্রাম থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় স্যাটেলাইট ইমেজে।
তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা গ্রামের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি অস্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনের ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর থেকে সোয়া সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে জাতিসংঘ বর্ণনা করে আসছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে। সেখানে গণহারে হত্যা-ধর্ষণ-জ্বালাওপোড়াওয়ের অভিযোগও মিয়ানমার অস্বীকার করে আসছে।
মিয়ানমার বলে আসছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু গত মাসে প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় দফা চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কথায় রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারার কারণে।
রোহিঙ্গাদের দাবি, প্রত্যাবাসনের জন্য আগে তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। জমি-জমা ও ভিটেমাটির দখল ফেরত দিতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাখাইনে তাদের সঙ্গে যা হয়েছে, সেজন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
অন্যদিকে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারার জন্য বাংলাদেশকে দুষছে। তারা যে সত্যিই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ‘প্রস্তুত’, তা দেখাতেই একদল বিদেশি সাংবাদিককে তারা দাওয়াত দিয়ে রাখাইনে নিয়ে যায় সম্প্রতি।
জোনাথন হেড বিবিসির ওই প্রতিবেদনে লিখেছেন, এমনিতে রাখাইনে বাইরের কারও ঢোকার সুযোগ নেই বললেই চলে। সাংবাদিকদের ওই দলটিকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় সামরিক প্রহরার মধ্যে। পুলিশের অনুমতি না নিয়ে ভিডিও করার বা কারও সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ ছিল না।
“তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে নির্মূলের প্রমাণ আমরা সেখানে স্পষ্ট দেখেছি।”
অস্ট্রেলিয়ার স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া রাখাইনের ওই অঞ্চলের ছবি বিশ্লেষণ করে বলছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের যে গ্রামগুলো সেনাবাহিনীর দমনপীড়নে ক্ষতিগ্রস্ত ও জনশূন্য হয়ে পড়েছিল, তার ৪০ শতাংশই মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যা দেখেছে বিবিসি
জোনাথন হেড জানান, কর্তৃপক্ষ তদের নিয়ে গিয়েছিল রাখাইনের হ্লা পো কং ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে ২৫ হাজার রোহিঙ্গার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য। বাংলাদেশ থেকে কেউ ফিরলে এই ক্যাম্পে তাদের দুই মাস রেখে পরে স্থায়ী আবাসনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা সরকারিভাবে বলা হচ্ছে।
“এই ক্যাম্প নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে। এখন এটার অবস্থা জঘন্য। গণশৌচাগারগুলো ভেঙে পড়েছে। এই ক্যাম্প তারা গড়ে তুলেছে হ রি তু লার এবং থর জে কোন নামের দুটি গ্রামজুড়ে। ২০১৭ সালে ওই অভিযানের পার রোহিঙ্গাদের এই গ্রাম দুটো পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়।”
জোনাথন হেড ওই ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সো সোয়ে অংয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, গ্রাম দুটো কেন তাদের নিশ্চিহ্ন করতে হল। উত্তরে সো সোয়ে অং বলেন, কোনো গ্রাম ধ্বংস করা হয়নি। কিন্তু জোনাথন হেড স্যাটেলাইট ইমেজের কথা তুললে মিয়ানমারের ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি মাত্র কিছুদিন হল এই দায়িত্বে এসেছেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের যে স্থায়ী আবাসনে নেওয়ার কথা, সেই কেইন চুয়াং রিলোকেশন ক্যাম্পেও বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে গিয়েছিল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘমেয়াদে বসবাসের জন্য এই ক্যাম্পের ঘরগুলো বানানো হয়েছে জাপান আর ভারতের অর্থায়নে।
এই ক্যাম্পের জায়গায় আগে মায়ার জিন নামে এক রোহিঙ্গা গ্রাম ছিল। বুলডোজার দিয়ে সেই গ্রাম গুঁড়িয়ে দিয়ে তারপর সেখানে বানানো হয়েছে ক্যাম্পের স্থাপনা। পাশেই বানানো হয়েছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের একটি নতুন ব্যারাক।
জোনাথন হেড লিখেছেন, ক্যাম্পের কর্মকর্তারা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে না চাইলেও নাম প্রকাশ না করে রোহিঙ্গা গ্রাম ধ্বংস করে এসব স্থাপনা গড়ে তোলার কথা স্বীকার করেছেন।
রাখাইনের মংডু শহরের ঠিক বাইরে একটি এলাকার নাম মায়ো থু গি, যেখানে এক সময় আট হাজার রোহিঙ্গার বসবাস ছিল।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আরও একবার বিদেশি সাংবাদিকদের মায়ো থু গিসহ রাখাইনের কয়েকটি জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। বিবিসির জোনাথন হেডও ছিলেন সাংবাদিকদের ওই দলে।
সে সময় মায়ো থু গিতে বেশ কয়েকটি বাড়ি পুড়তে দেখেছিলেন জোনাথন হেড, সেই ছবিও প্রকাশ করেছিল বিবিসি। তবে বড় কয়েকটি বাড়ি তখনও অক্ষত ছিল, গ্রামের চারপাশের গাছপালাও ছিল।
কিন্তু এবারের সফরে ওই জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় ওই গ্রামের জায়গায় একটি বড় সরকারি ভবন এবং একটি পুলিশ কমপ্লেক্স দেখতে পাওয়ার কথা লিখেছেন জোনাথন হেড। এবার কোনো গাছও সেখনে তিনি দেখেননি।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সেনা অভিযানের মধ্যে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলার ঘটনায় কুখ্যাত ইন দিন গ্রামেও এবার বিদেশি সাংবাদিকের দলটিকে নিয়ে গিয়েছিল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।
জোনাথন হেড লিখেছেন, এক সময় ওই গ্রামের তিন চতুর্থাংশ বাসিন্দা ছিলেন রোহিঙ্গা মুসলমান, বাকিরা বৌদ্ধ মগ। আর এখন রোহিঙ্গাদের কোনো চিহ্ন সেখানে নেই।
বৌদ্ধদের বাড়িগুলো ঠিকই আছে, তবে রোহিঙ্গাদের পাড়া যেখানে ছিল, সেখানে এখন কাঁটাতরের ঘেরাওয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বর্ডার গার্ড পুলিশের একটি নতুন ব্যারাক। গ্রামের গাছগুলোর কোনো চিহ্নও এখন সেখানে নেই।
“ওই গ্রামের বৌদ্ধরা আমাদের বলেছেন, আর কখনও কোনো মুসলমানকে তারা তাদের পাশে ঘর বানিয়ে থাকার সুযোগ দেবেন না।”