আমদানি নির্ভরতা কমাতে যশোরে চাষীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে পেঁয়াজ চাষে

গত বছর ১৫ কাঠা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন মিজানুর রহমান। সেবার খরচের প্রায় দ্বিগুন টাকা লাভ হয়েছিলো তার। ফলে চলতি মৌসুমে বেশ আগেভাগেই মুড়িকাঁটা পেঁয়াজের আবাদ শুরু করছেন তিনি। বাড়িয়েছেন জমির পরিমাণও। গতবারের ১৫ কাঠার স্থানে এবার এক বিঘা জমিতে করছেন আবাদ।

মিজানুর রহমান বলেন, পেঁয়াজের দাম অনেক ওঠানামা করে। গত কয়েক বছর ধরে দেখছি যখন দেশীয় পেঁয়াজ ওঠে, তখন ভারত থেকেও পেঁয়াজ আসে। গতবার আগাম চাষ করে লাভ করেছিলাম। কিন্তু এর আগের বছরগুলোতে দাম পড়ে যাওয়ায় লাভের টাকা ঘরে তুলতে পারিনি।

যদি সরকার পরিবেশ, পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে চাষী লাভবান হবে। সেক্ষেত্রে আবাদ বাড়বে। তখন পেঁয়াজের জন্য কারও মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না বাংলাদেশকে। যশোরের বাজারে বর্তমানে দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।

গত বছর পেঁয়াজের দাম ছাড়িয়েছিলো ৩শ’ টাকা। এর আগের বছর ২শ’ ছাড়ায় নিত্য এ পণ্যটির দাম। এভাবে গত কয়েক বছর ধরেই দেশে অস্থিতিশীল পেঁয়াজের বাজারদর। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রপ্তানীর ওপর নির্ভর করেই দামের এ হেরফের।

যা থেকে উত্তরণের জন্য বিকল্প পথে হাঁটছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহিরুল ইসলাম জানান, বছরের একটি কিম্বা দুটি সময়ে এসে পেঁয়াজের দাম সাধারণের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে।

ফলে আমদানি নির্ভরতা কমাতে বিগত বছরগুলোতে চাষীদেরকে পেঁয়াজ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রনোদনা ও ভর্তুকির মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে বীজ ও চারা গাছ। আর ভালো মূল্য পেতে তাদেরকে আগাম পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে অনেক চাষীই নির্ধারিত সময়ের আগেই মুড়িকাঁটা পেঁয়াজের আবাদ শুরু করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ২০১৬-১৭ মৌসুমে যশোরে ১৩শ’ ৬০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছিলো। পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৫ হেক্টরে।

২০১৮-১৯ মৌসুমে বাড়লেও এর পরিমাণ ছিলো ১২শ’ ৫০ হেক্টর। কিন্তু ২০১৯ সালে পেঁয়াজের কেজি ২শ’ টাকা ছাড়ালে অনেক কৃষকই আবাদে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ওই মৌসুমে জেলায় ১৪শ’ ৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছিলো। কিন্তু গত বছর পেঁয়াজের দাম সর্বকালের রেকর্ড গড়লে নড়েচড়ে বসে কৃষি বিভাগ ও চাষী।

তারই ফলশ্রুতিতে চলতি মৌসুমে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫শ’ হেক্টর বেশী জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করছে কৃষক। অর্থাৎ এ মৌসুমে ১৯শ’ ২০ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে পেঁয়াজের। যা যশোর জেলার ইতিহাসে পেঁয়াজ আবাদের সর্বোচ্চ রেকর্ড।

কিন্তু পেঁয়াজের আবাদ নিয়ে বড় ধরণের শংকা রয়েছে কৃষকের মাঝে। রবিউল ইসলাম নামের এক কৃষক বলেন, গতবার ১২ কাঠা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছিলাম। খরচ হয়েছিলো ১৯ হাজার টাকা। কিন্তু যখন ফসল উঠতে শুরু করলো, তখনই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলো।

এতে আমরা লোকসানে পড়লাম। এত পরিশ্রম করে মাত্র ৩ হাজার টাকা হাতে পেয়েছি। ইসমাইল হোসেন বলেন, ২০১৬ সালে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলাম। কিন্তু ফসল ওঠার মুখে ধরা খেলাম। লাভতো দূরের কথা, সেবার খরচের টাকাই তুলতে পারিনি। যে কারণে গত চার বছর চাষ করিনি।

তবে এবার শংকা নিয়ে আবাদ শুরু করেছি। শুধু রবিউল কিম্বা ইসমাইল’ই নন, পেঁয়াজ চাষীদের বেশীরভাগেরই অভিযোগ আমদানি নীতি নিয়ে। তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই দেশে পেঁয়াজের সংকট রয়েছে। যে সংকটের কারণে নিত্য এ পণ্যটির দাম অনেক সময় লাগামহীন হয়ে ওঠে।

তাই চাহিদা মেটাতে আমরাও আবাদ করি। কিন্তু এত কষ্টের ফসল ন্যায্যমূল্যে ঘরে তোলা সম্ভব হয়না। এতে আবাদের প্রতি অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। কৃষকদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের কারণে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, কিন্তু মজুতদাররা লাভবান হচ্ছেন।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক এএসএম হুমায়ূন কবির কবু বলেছেন, পেঁয়াজ সংকট মেটাতে উৎপাদনের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে চাষীদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য যেমন আমদানি নীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন তেমনি শক্ত হাতে অসাধু ব্যবসায়ীদেরও দমন করা উচিত।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদনের মূল সময় শীতকাল। কিন্তু সংকট উত্তরণে এবার আগাম চাষ শুরু করা হয়েছে। গত ৫ বছরের হিসেবে যশোরে চলতি মৌসুমে ৪১ শতাংশ বেশী এলাকায় পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে।

যেখান থেকে ২২ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদনের আশা রয়েছে। প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস আরও বলেন, শীতকালের পাশাপাশি গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালেও পেঁয়াজের আবাদ করা হবে। সেলক্ষ্যে ইতিমধ্যে এক হাজার চাষীকে প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে নগদ অর্থ, বীজসহ আনুসাঙ্গিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে।

ফলে অফসিজনে হেক্টর প্রতি ১৫-২০ টন পর্যন্ত পেঁয়াজ তুলতে পারবেন চাষীরা। এতে বাজারে যেমন পেঁয়াজের ঘাটতি কমবে, তেমনি চাষীও লাভবান হবে।