পরিবর্তনের আশায় বিএনপি

বিএনপি’র জন্য স্মরণীয় দিন ১লা সেপ্টেম্বর। ১৯৭৯ সালের এইদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দলটি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে ও ১৯ দফার ভিত্তিতে গঠিত দলটি নানা ভাঙা-গড়া ও উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে পার করেছে সুদীর্ঘ ৪০ বছর। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে মজবুত জনভিত্তি তৈরির পাশাপাশি দলটি রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেছে চারবার।

চারদশকের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথমবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় বিএনপি। পরের তিনবার সরকার গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারই সহধর্মিণী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে প্রশংসিত হয়েছে বিএনপি।

দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র না থাকায় সমালোচনাও হয়েছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা রাখেন খালেদা জিয়া। নির্বাচনে জিতে দেখান চমক। কখনো সরকার, কখনো বিরোধী শিবিরে এভাবেই চলছিলো বিএনপির রাজনীতি। সবচেয়ে বড় আঘাত হয়ে আসে ২০০৭ সালের আলোচিত ওয়ান ইলেভেন। সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক গ্রেপ্তার হন খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতারা।

দুইবছর গুমোট সময় পেরিয়ে নবম জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও জরুরি আমলের সে বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। উল্টো দীর্ঘায়িত হয়েছে সে দুঃসময়। ওয়ান-ইলেভেনের সে সূত্র ধরে এখন প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিএনপি। আন্দোলন-সংগ্রাম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিছু ভুল ও বিলম্বিত পদক্ষেপ দলটিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল থেকে শেষ পর্যন্ত বর্জন করেছে দশম জাতীয় নির্বাচন। সে নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে কম থাকলেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে। উল্টো সংসদীয় রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে বিএনপি।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০১৫ সালে। একতরফা দশম নির্বাচনের বর্ষপূর্তির কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে টানা প্রায় দুই মাস অবরুদ্ধ দিন কাটিয়েছেন তিনি। অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার ঘোষিত হরতালসহ অনির্দিষ্টকালের আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তৈরি হয়েছিল এক অরাজক পরিস্থিতি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের ওপর চেপে বসে মামলার পাহাড়। গ্রেপ্তার হন হাজার হাজার নেতাকর্মী। পরে অনির্দিষ্টকালের সে কর্মসূচিটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয় রাজনৈতিক মহলে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর কোনো ফলাফল ছাড়াই রাজপথের কর্মসূচি থেকে সরে আসে বিএনপি। এরপর প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতায় ঘরবন্দি হয়ে পড়ে দলটির রাজনীতি।

অন্যদিকে জনগণের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ সময়েও সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় দলটি। তবে সমূহ বিপর্যয়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে ধীরে চলো নীতি নেয় বিএনপি। তারই প্রেক্ষিতে বিগত তিন বছর ধরে রাজপথ উতপ্তকারী কর্মসূচি থেকে বিরত রয়েছে দলটি। এ ধীরে চলো নীতির ফলে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হয় দলটির সামনে।

এদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চলতি ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ৫ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠান আদালত। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন একদশক ধরে লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমান। তারই নির্দেশনায় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের যৌথনেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে বিএনপি’র কার্যক্রম। তবে খালেদা জিয়ার কারাবন্দি ও তারেক রহমান বিদেশে অবস্থান করায় নেতৃত্ব নিয়ে কিছুটা হলেও জটিলতায় রয়েছে বিএনপি।

অন্যদিকে এগিয়ে আসছে আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময়কাল। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ফাঁকা মাঠ দেয়া হবে না- এমন ঘোষণা দিয়ে রেখেছে বিএনপি। বিগত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে এসেছেন খালেদা জিয়া। তখন তেমন সাড়া পাওয়া না গেলেও জাতীয় রাজনীতিতে একটি বৃহত্তর ঐক্যের তৎপরতা এখন জোরালোভাবে দৃশ্যমান। মধ্যপন্থি কয়েকটি দলের তৎপরতায় সে বৃহত্তর ঐক্যের অংশীদার হচ্ছে বিএনপি। আর এ বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আন্দোলন ও নির্বাচনের মাধ্যমে বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চায় দলটি।

রাজনীতিতে বিএনপি’র সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বিবেচিত হয় সাংগঠনিক ক্ষেত্রে। বারবার বিপর্যয় ও বর্তমান ক্রান্তিকাল থেকে উত্তরণে ব্যর্থতার জন্যও নেতাদের আত্মোপলব্ধি হচ্ছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব এবং সাংগঠনিক ব্যর্থতা। তবে ষষ্ঠ কাউন্সিলে দলের গঠনতন্ত্রে ‘এক নেতা এক পদ’ নীতি সংযুক্তি ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনেকটাই ফিরিয়ে এনেছে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা।

দলটির ৪০ বছরের পথচলার ইতিহাসে আড়াই দশকই আন্দোলন-সংগ্রামের। বারবার ভাঙা-গড়া ও উত্থান-পতনের শিকার হয়েছে বিএনপি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব বাংলাদেশ যখন স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত পদে তখনই একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন তিনি। বাংলাদেশ পড়ে এক দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের কবলে।

দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় এলে তার বিরুদ্ধে টানা নয় বছর আন্দোলন করে বিএনপি। কখনও একক, জোটের মাধ্যমে এগিয়ে নেয় সে আন্দোলন। যে আন্দোলনে অনড় মনোভাবের কারণে আপসহীন নেত্রীখ্যাত হন খালেদা জিয়া। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সপ্তম সংসদে আন্দোলন ছিলেন বিরোধী দলের ভূমিকায়। ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত সরকারের সময়ে সদ্য ক্ষমতাত্যাগী হিসেবে নেতাকর্মীদের নির্যাতন সহ্য করার পাশাপাশি দলটি মেতে ছিল গণতন্ত্র পেরোনোর আন্দোলনে। মহাজোটের নেতৃত্বাধীন নবম ও দশম সংসদেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।

আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপি’র একটি দর্শন হচ্ছে মৌলিক ইস্যুতে আপসহীন মনোভাব ধরে রাখা। অতীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ আপসহীন মনোভাবই সাংগঠনিকভাবে একটি ভঙ্গুর ও অগোছালো বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিল জনগণ। যা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আপসহীন মনোভাবটা নিয়ে প্রশ্ন উঠে দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জনের মধ্যদিয়ে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’র সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে বিভিন্ন পথ ও মতের ঐক্যের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘদিন থেকেই সাংগঠনিক ও জনসমর্থনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি।

ভাঙা-গড়ার খেলাটি যে কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা ও ষড়যন্ত্রের যৌথরসায়ন। রাজনৈতিক ইতিহাসে ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়েই শুরু হয় বিএনপি’র ভাঙা-গড়ার খেলা। জিয়াউর রহমানের জাগদল ও বিএনপিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন বহুদলীয় ও বহুমতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সেই সঙ্গে রাজনীতি সচেতন বিদগ্ধজনদের সমাবেশ। জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণের পর ’৮৩ সালে প্রথম ভাঙন ঘটান শামসুল হুদা চৌধুরী ও ডা. মতিন। তারই ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচার এরশাদ আমল, ওয়ান-ইলেভেনসহ নানা সময়ে ছোটখাট ভাঙনের শিকার হয়েছে বিএনপি। সবচেয়ে বড় ধরনের ভাঙনটি ঘটে অষ্টম সংসদ ও ওয়ান-ইলেভেনের সময়। পরবর্তী সময়ে অনেকেই ফিরেছেন বিএনপি’র ছায়াতলে, অনেকে রাজনীতিতেই হয়ে পড়েছেন নিষ্ক্রিয়। এসবের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠাকালীন বহু প্রভাবশালী ও সম্ভাবনাময় নেতা বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ছেড়েছেন। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার ভাঙা-গড়ার খেলায় জড়িত হলেও তৃণমূল নেতৃত্ব ছিল সবসময় ঐক্যবদ্ধ।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি: ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুইদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ভোরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়সহ সারা দেশে দলের কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ১১টায় দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে ফাতেহা পাঠ, পুষ্পমাল্য অর্পণ। বেলা ২টায় নয়াপল্টনে জনসভা। আগামীকাল রোববার বিকাল ৩টায় রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে রাখা হয়েছে আলোচনা সভা। দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা আলোচনা করবেন। উল্লেখ্য, দলটির আবেদনের প্রেক্ষিতে নয়াপল্টনে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জনসভা করার মৌখিক অনুমতি দিয়েছে পুলিশ। এছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হবে পোস্টার। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সারা দেশে দলের সকল মহানগর-জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন শাখাগুলোতে নিজস্ব কর্মসূচি পালন করা হবে।

বিএনপি’র ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী এবং দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বাণী দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার বাণীতে দেশনেত্রীর মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে হারানো ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং বাক-ব্যক্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ জনগণের মানবিক মর্যাদা সুরক্ষা করাকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অঙ্গীকার হিসেবে ব্যক্ত করেন। মহাসচিব তার বাণীতে বলেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থেকে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সূত্র: মানবজমিন