ভুতুড়ে মামলা আতঙ্ক

গত ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পোস্তাগোলার ইগলবক্সের সামনে অরাজকতা ও গাড়ি ভাংচুরের অভিযোগে ‘১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমাত আইনে’ কমদতলী থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। মামলা নম্বর ১৩। ওই মামলায় ঢাকা-৪ (শ্যামপুর, কদমতলী) আসনের সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন, তার ছেলে রবিন, ছাত্রদলের ৩ নং ওয়ার্ড সভাপতি জুম্মন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সাবেক যুগ্ন সম্পাদক আনোয়ার কবিরসহ ১৯৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে লোহার রড, কাঠ, গাছের লাঠি ও কাঁচের ভাঙা অংশসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করেছে পুলিশ। খবর ইনকিলাব।

এদিকে, ভাংচুরের অভিযোগের একদিন পর ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকাবাসী ও স্থানীয় দোকানদারদের সাথে কথা বললে তারা জানায় ভিন্ন কথা। স্থানীয়দের ভাষ্য, ৫ সেপ্টেম্বর এত বড় ভাংচুরতো দূরে থাক, সাধারণ কোন ভাংচুরের ঘটনাও ওই স্থানে ঘটেনি। তাদের ভাষ্য, ইগলবক্সের সামনে এত বড় ঘটনা ঘটলে প্রত্যক্ষদর্শীসহ এলাকার অনেক মানুষ সেটি জানতো।

এ মামলাটির বিষয়ে এজাহারে আসামীর তালিকায় থাকা কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, কোনো অপরাধ ছাড়াই অনর্থক হয়রানির জন্য পুলিশ এমন ‘ভুতুড়ে’ মামলা দিচ্ছে। এটি রাজধানীর একটি থানার ঘটনা নয়। প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারাদেশে এমন ‘ভুতুড়ে’ মামলা করছে পুলিশ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিরোধীদল ও ভিন্ন মতাদর্শের লোকদের দমনে সরকারের মদদে পুলিশ এ সব মামলা করছে।

এদিকে, ‘ভুতুড়ে’ মামলার বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সারাদেশে ব্যাপকহারে ‘ভুতুড়ে’ মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে। গত অর্ধমাসে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্র্মীদের বিরুদ্ধে ১৫শ’র বেশি মামলা ও এসব মামলায় ১ লাখের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গত কয়েকদিনে বিভিন্ন থানায় দায়ের করা ‘ভুতুড়ে’ মামলা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বিষয়টি নিয়ে জনমনে আরও বেশি আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। এমন মামলার কয়েকজন ভুক্তভোগী ও স্বজনরা অভিযোগে জানান, প্রায় প্রতিদিনই দুই/তিনবার সিভিল ড্রেসে পুলিশ তাদের বাড়িতে হানা দিচ্ছে। পুলিশের আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে ‘দরকারী তথ্য সংগ্রহ’ করতে আসছেন বলে পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বজনদের জানায়। এতে করে ভয়ে অনেকেই এখন ঘরছাড়া।

দনিয়া এলাকার বিএনপির এক নেতা টেলিফোনে বলেন, মামলার খবর পেয়ে গত কয়েকদিন ধরেই তিনি পলাতক। পুলিশ প্রায়ই তার খোঁজখবর করছে। কতোদিন এভাবে পালিয়ে থাকবেন এমন প্রশ্নের জবাবে ওই নেতা বলেন, হয়তো একদিন ধরা পড়তেই হবে। এভাবে কি আর পালিয়ে থাকা যায়। ডেমরা এলাকার এক ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে বলেন, মামলার পর তিনি ও তার ছেলে দুজনেই পলাতক। এ কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।

পরিবারের লোকজন কিভাবে চলবে সে চিন্তায় অস্থিরতার কথা জানিয়ে ওওই ব্যবসায়ী বলেন, শত্রুেতাবশত আসামীর তালিকায় আমাদের বাপবেটার নাম দেয়া হয়েছে। আমরা তো কোনো রাজনীতি করি না।

গত ৫ সেপ্টেম্বর ইগলবক্সের সামনে ভাংচুরের মামলার বিষয়ে জানতে মামলার বাদী কদমতলী থানার এসআই আকতারকে কল করলে তিনি মামলার বিষয়ে কোনো কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। ওই এসআই বলেন, ‘আপনি থানায় আসেন। মামলার বিষয়ে আমাদের কোনো কিছু বলা নিষেধ। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেন।’

এ বিষয়ে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাজু মিয়ার সাথে গতকাল মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভাংচুরের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। এমন ভাংচুরের বিষয়ে স্থানীয়রা কিছুই জানেন না বলেলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষ এমনই।’ তিনি বলেন, ‘এলাকার দক্ষিণ পাশের একটি বাড়িতে প্রায় সময় বিএনপি, জামায়াতসহ নাশকতাকারীরা মিটিং ও শলাপরামর্শ করে। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। পুলিশও বাড়িটি সনাক্ত করেছে। শীঘ্রই ওই বাড়িতে অভিযান চালানো হবে।’

এদিকে, ভাংচুরের মামলার এজাহারে তিনজন স্বাক্ষীর কথা উল্লেখ রয়েছে। ইনকিলাব থেকে দু’জনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তাদের আচরণ সন্দেহজনক বলে মনে হয়।

এজাহারে স্বাক্ষী হিসেবে উল্লেখ আল আমিনকে গতকাল কল করা হলে তিনি থতমত খেয়ে যান। ‘কখন ভাংচুর হয়েছে’-সেটি জানতে চাইলে তিনি সঠিক সময়ও বলতে পারেননি। তিনি একবার সকাল বললে আরেকবার বিকেলের কথা বলেন। পরে পার্শবর্তী একজনের সাথে কথা বলে ‘সকালের দিকে’ ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানান। যদিও দায়েরকৃত মামলায় ঘটনার সময় রাত ৮টা ২৫ মিনিট বলে উল্লেখ রয়েছে।
আরেক স্বাক্ষী নুরুল ইসলামকে কল করে ৫ সেপ্টেম্বর তার চোখের সামনে কোনো ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি ‘না’ সূচক জবাব দেন। পরে ঘটনাটি খুলে বললে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে মোবাইলে কিছুই বলতে পারবো না। আপনি মামলার বাদির সাথে কথা বলেন, তাকে অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে যদি কিছু বলতে হয় আমি আদালতে বলবো।’

এদিকে, গত কয়েকদিনে গণমাধ্যমে ‘ভুতুড়ে’ মামলা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর ওয়ারীর বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাব মাঠে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জমায়েত হয়ে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে ৯৬ জনকে আসামী করে একটি মামলা করে ওয়ারী থানা পুলিশ। ওই মামলায় উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত ৮২ বছর বয়স্ক লুৎফুল কবিরকে আসামী করা হয়।

অথচ পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে, গত ৪ আগস্ট থেকে পরবর্তী সাতদিন ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে ১১ আগস্ট হাসপাতালে বাড়ি ফেরেন লুৎফুল। তিনি কারো সাহায্য ছাড়া একাকী চলাফেরা করতে পারেন না। অথচ তিনি কিভাবে ষড়যন্ত্রে উপস্থিত ছিলেন সেটি বোধগম্য নয়। এ ছাড়া পুলিশ যেদিন মামলা দিয়েছে, সেদিনও তিনি বাড়িতেই ছিলেন বলে স্বজনরা জানায়।

একইভাবে বিদেশ থেকেও ‘সরকারবিরোধী’ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা সাব্বির আহমেদ আরিফকে একই মামলায় পুলিশ আসামি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভিসা, ইমিগ্রেশন, হোটেলের কাগজপত্র এবং কলকাতা থেকে তার ফ্লাইটের বোর্ডিং পাসের তথ্য মতে তিনি গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করেছেন বলে গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ অহেতুক হয়রানি করার জন্য এমন অবান্তর মামলা করেছে বলে সাব্বির বলেন। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের ওই মামলার সাব্বিরকে ১৩ এবং লুৎফুল হককে ৫১ নম্বর আসামি করা হয়েছে।

গত রোববার একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর চকবাজার থানা বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল আজিজুল্লাহ মারা গেছেন ২০১৬ সালের মে মাসে। মৃত্যুর প্রায় ২৮ মাস পর তাকে একটি মামলায় আসামি বানিয়েছে পুলিশ। চকবাজার থানায় গত ৫ সেপ্টেম্বর দায়ের করা ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়েছেন তিনি। এমনকি অন্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটিয়েছেন।

এদিকে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান ধরপাকড় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংবিধান প্রণেতা, গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ব্যারিস্টার ড. কামাল হোসেন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল বলেন, ‘সাদা পোশাকে ধরপাকড়ের ব্যাপারে তদন্তের দরকার। এরা কারা?’ তিনি বলেন, ‘পোশাক দেওয়া হয় যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে তারা রাষ্ট্রের দায়িত্ববান লোক। পোশাক না পরলে মানুষ ধরে নিতে পারে- এরা হলো ছিনতাইকারী! এরা মানুষকে অন্যায়ভাবে কিডন্যাপ করছে। আইনে সাদা পোশাক পরে কাউকে গ্রেফতার করার বিধান নেই।’

হঠাৎ ধরপাকড় আতঙ্ক, পুরনো মামলা সচল করা, ঘটনা না ঘটলেও পুলিশের মামলা করার অভিযোগ তুলে বিশিষ্ট এ আইনজীবী বলেন, ‘সাংবিধানিক শাসন যেখানে থাকে সেখানে পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে। যেখানে স্বৈরতন্ত্র থাকে সেখানে ইচ্ছামত লোকজন ধরা যায়, মানুষকে গুম করা যায়।’ তিনি আরও বলেন, সাংবিধানিক শাসন থাকলে কাউকে ধরলে বলতে হবে- তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে হাজির করতে হবে। যাতে তিনি জামিন নিতে পারেন।’