আশা করি আগামী নির্বাচন সহিংসতামুক্ত হবে : বার্নিকাট

‘গণতন্ত্রে নাগরিকের যেসব বিষয় থাকা দরকার বর্তমানে বাংলাদেশে তা দেখা যাচ্ছে না, তবে আমরা আশা করি আগামী নির্বাচন সহিংসতামুক্ত হবে’ এভাবেই নিজের অভিমত তুলে ধরলেন ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লু ম বার্নিকাট।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, অন্যদের ছাড়া নির্বাচন করে সরকার গঠন করা কখনই ভাল হতে পারে না। গণতন্ত্র হচ্ছে কষ্টসাধ্য ও কঠিন বিষয়। এক নির্বাচন থেকে আরেক নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, এর মধ্যে (৫ বছর মেয়াদে) যেসব নির্বাচন (স্থানীয় ও উপনির্বাচন) হয়েছে তা প্রতিযোগিতামূলক এবং অংশগ্রহণমূলক। কিন্তু সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে।

গতকাল চ্যানেল আই এর টকশো তৃতীয় মাত্রায় তিনি এসব কথা বলেন। জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় ওই টকশোতে তিনি ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেমন প্রশংসা সুচক কথা বলেন; তেমনি জনগণের ভোট দিতে না পারা, ভোটের সময় ভায়োলেন্স, ইসির কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার না পাওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নিজের অভিমত তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করার আহবান জানান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতি জোর দেন এবং সর্বত্রই জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।

মার্শা বার্নিকাট বলেন, একটা দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো গণতন্ত্রের যেসব প্রতিষ্ঠান সেগুলোকে শক্তিশালী করা। আমেরিকার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, যেমন আমাদের অনেক শক্তিশালী বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ রয়েছে। এর বাইরেও আমাদের শক্তিশালী গণমাধ্যম রয়েছে। গণমাধ্যম দেশের ভেতরে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তারা আমাদের সমালোচনা করে, আমাদের কথা ও কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের সব উপাদানগুলো রয়েছে। যার উদাহরণ হচ্ছে ১৯৭১ এবং ১৯৫২। ’৫২ সালে এখানে অন্য একটি ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ছাত্ররা প্রতিবাদ করলো, বললো ‘না’। এজন্য তাদের কয়েকজনকে জীবনও দিতে হয়েছে। এটার জন্যই গণতন্ত্র নতুন ডিএনএ পেয়েছে। এখানকার মানুষ অন্যায় হলে প্রতিবাদ করে। মানুষ তাদের মতো করে, পছন্দ মতো সরকার বানায়। কারণ আমরা গণতান্ত্রিক নাগরিক। একারণে আমরা ত্রু টিপূর্ণ সরকারের অধীনে বাস করি, তারা ত্রু টিপূর্ণ হয় তখন যখন মানুষ ত্রু টিপূর্ণ হয়। কিন্তু জনগণই পারে জনগণের প্রতি সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে। কেননা গণতন্ত্র হচেছ একটি বাসের মতো। যেখানে সরকারের কাজের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু চূড়ান্তভাবে জনগণই এর জন্য দায়ি থাকে। শুধু গণতন্ত্রের বেসিক ড্রাইভ ঠিক থাকলেই বলা যাবে না যে, গণতন্ত্র যথাযথভাবে চলছে নিখুঁতভাবে কাজ করছে। এটাকে এগিয়ে নিতে হবে। আমি দেখেছি যে এটাকে এগিয়ে নেয়ার কাজ চলছে।

আগামী নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী জানতে চাইলে বার্নিকাট বলেন, আপনি যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর কোন দেশেই দেখবেন না যে, সেখানে নির্বাচনে পরাজিত হওয়া মানে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে এমন মনে করা হয়। আপনি নির্বাচনে পরাজিত হওয়া মানে আপনি সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছেন।

কিন্তু এখানে (বাংলাদেশে) সেটা মনে করা হয়। এখানে নির্বাচনে পরাজিত হওয়া মানে মনে করা হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, দেশ-শাসন কেন্দ্রীক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাড়ি-ঘর, পরিবার, স্বাধীনতা সবকিছু হারিয়ে ফেলেছেন। পরাজিত হলে তাদেরকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে। অথচ পরাজিত হওয়া মানে আপনি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। বেশ, এখন আপনি অন্য কোন কিছু করেন। বিরোধী দলের রাজনীতিবিদরা হতে পারেন ব্যাংকার, আইনজীবী, ডাক্তার অথবা অন্য যে কোন পেশার। এটা হওয়া উচিত পরাজিত হওয়ার মূল্য এবং এই ধরণের একটি ঐতিহ্য, ধারা বাংলাদেশে গড়ে তোলা উচিত।

রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে উত্তরণের বিষয় প্রসঙ্গে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, দেশে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকে তাহলে তখন গণতন্ত্র ডিফাইন করা কঠিন। তারপরও গণতন্ত্রই হলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি। তবে প্রশ্ন হলো কিভাবে এই বিরোধীপূর্ণ বিষয়গুলোর সমাধান করবেন? দেশে যদি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকে, শক্তিশালী, রাজনীতিবিদ, সমাজ, বুদ্ধিজীবী, যারা তাদের চিন্তুভাবনা, আইডিয়ার মাধ্যমে সঙ্কট উত্তোরণে ভূমিকা রাখবে। তাহলে সঙ্কট থেকে উত্তোরণ সম্ভব, অস্থিরতা দূর হবে এবং দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানাই, যারা গোটা জাতির কথা চিন্তা করে রাস্তায় নেমেছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে। এবং তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে সবকিছুর সমাধান করা যায়। এটাও একটা বিষয় যে, আপনার দেশের জন্য উচ্চাকাক্সক্ষা রয়েছে, ভাল কিছু চিন্তা করছেন, এক্ষেত্রে সরকার কতটা আন্তরিক বা সাড়া দিচ্ছে।

নির্বাচনে সহিংসতা এবং নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই সময়ে কিছু নির্বাচন হয়েছে। মানুষ ভোট দিতে যাবে, যেখানে কোন ভয়-ভীতি, হুমকি থাকবে না। কারণ এখানকার (বর্তমান সময়) ইতিহাস হচ্ছে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকী দেয়া হয়। ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখেছে যে তাদের ভোট আগেই দিয়ে দেয়া হয়ে গেছে। এর জন্য তাদের নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করার মতো কোন ব্যবস্থা নেই। নাগরিক হিসেবে তাদের যে কর্মকান্ড করতে পারছে কিনা। গণতন্ত্রে নাগরিকের যেসব বিষয় থাকা দরকার তা দেখা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি এবং আশা করি আগামী নির্বাচন সহিংসতামুক্ত হবে। কারণ এখানে নির্বাচন কেন্দ্রীয় সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যদিও আমরা গত ৫টি সিটি করপোরেশন দেখেছি সেখানে কোন ধরণের সহিংসতা হয়নি এজন্য আমি ধন্যবাদও জানিয়েছি। তবে এর সাথে আমরা এটিও দেখতে চাই যে, ভোট কেন্দ্রে যেতে ভোটাররা ভয় পাবে না, কোন ধরণের হুমকী-ধামকি দেয়া হবে না। যেন মানুষ নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে। তবে যদি মানুষ মনে করে যে তাদের নিজেদের মতামত প্রকাশ করা কঠিন বা সুযোগ নেই তাহলে সহিংসতা এড়ানোর সুযোগ থাকবে না। সহিংসতা এড়ানোর বড় সুযোগ হচ্ছে জনগণকে নির্বাচন পদ্ধতি বা নির্বাচনের সাথে সংযুক্ত রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের ভূঁয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, আসন্ন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যু জোড়ালো ভাবে উত্থাপন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার জনগণ, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

সঞ্চালকের এক প্রশ্নের জবাবে বার্নিকাট বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। দক্ষিণ এবং পশ্চিম এশিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এবং অত্যন্ত ভাইব্রেন্ট জায়গা এটি। দুঃখের সাথে বলতে হয় পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামকে, মুসলমানদের নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয় বিভিন্ন সময় সহিংসতায় জড়ানোর কারনে। কিন্তু বাংলাদেশই বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ যেখানে ধর্মীয় উগ্রতা নেই, নেই কোন ধর্মকেন্দ্রীক সহিংসতা। ইসলাম ও মুসলমানদের দেশ হয়ে বাংলাদেশ মডারেট এবং টলারেট হিসেবে সারাবিশ্বের কাছে অনুকরণীয়। এখানে সকলে মিলেই ধর্মীয় উৎসবগুলো পালন করে। কেউ কাউকে ধ্বংস করতে চায় না। আমি বাংলাদেশের মানুষকে বলবো আপনাদের কথা, গল্প, আপনাদের ইতিহাস সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ অতীত রয়েছে, নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। তারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু আজকে —! তিনি বলেন, এখানে অনেক সুযোগ রয়েছে। এটা বিশ্বকে জানাতে হবে, ইউরোপ, আমেরিকার কাছে তুলে ধরতে হবে। তাদেরকে বলতে হবে এখানে এই এই ধরণের সুযোগ-সুবিধা আছে, সম্ভাবনা আছে, সেটা ব্যবসা, বাণিজ্য কিংবা অন্য যে কোন বিষয়েই। তারা এখানে আসতে পারে অংশ নিতে পারে বাণিজ্য ও উন্নয়নে। যদিও আমরা (আমেরিকা) ইতোমধ্যে আপনাদের বাণিজ্য অংশীদার।