মির্জা ফখরুলের সফরে তোলপাড়

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত মঙ্গলবার রাত ২টায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকার সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব। বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চান। প্রয়োজনে জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচনেরও দাবি জানায় বিএনপির প্রতিনিধি দল। মির্জা ফখরুলের এই সফর এবং বৈঠকের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিএনপির সাথে জাতিসংঘ প্রতিনিধির বৈঠকে কি আলোচনা হয়?

আগে থেকে এই সফরের কোন সংবাদ না থাকায় আওয়ামী লীগ নেতারাও রয়েছে অন্ধকারে। সফর এবং বৈঠক নিয়ে স্বচ্ছ নয়, বরং মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। বিষয়টি আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির মধ্যে শুরু হয়েছে কথার লড়াইও। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মির্জা ফখরুলের এই সফরকে ব্যক্তিগত ও ব্যর্থ সফর হিসেবে প্রমাণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কয়েকদিন ধরেই সমলোচনায় মুখর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা। তারা বলছেন, দেশের মানুষের আস্থা হারিয়ে নালিশ জানাতেই বিদেশিদের দ্বারস্থ হচ্ছে বিএনপি।

অন্যদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, সারা বিশ্বই জানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার আমন্ত্রণে এবং কেন নিউইয়র্ক সফর করছেন। তিনি কোন নালিশ নয়, দেশের বাস্তব চিত্র (অত্যাচার, নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন) তুলে ধরতে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের চরিত্র হলো তারা মিথ্যাচার করে প্রতিপক্ষকে ছোট করতে চায়। বাস্তবতাকে মিথ্যার আবরণে ঢাকতে চায়। কিন্তু সব সময় তা সফল হয় না।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, মির্জা ফখরুলের এই সফর নিয়ে পুরোপুরি অন্ধাকের ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এমনকি বিএনপি মহাসচিব বিমানবন্ধরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্তও তারা জানতেন না মির্জা ফখরুল জাতিসংঘের আমন্ত্রণে নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। ফলে সরকারের মধ্যে একটা ভীতি ও আতঙ্ক কাজ করছে বিএনপি মহাসচিবের এই সফর নিয়ে। তাই তারা উদ্ভট সব কথাবার্তা ও যুক্তি দিয়ে সফরকে বিতর্কিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।
যদিও এই সফরকে এখন পর্যন্ত সফল বলে দাবি করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের নেতারা। দলের প্রতিনিধিরা বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের প্রতিনিধির সাথে বৈঠকের পর ওয়াশিংটন ডিসিতে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধির সাথে বৈঠক করতে।

জাতিসংঘে মিরোস্লাভ জেনকার সাথে বৈঠক শেষে নিউইয়র্ক থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীল বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণে আমরা এখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) এসেছি। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়গুলোও জানানো হয়েছে। আমরা কথা বলেছি, তারাও কথা বলেছেন। পরবর্তীতে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্র স্টেট ডিপার্টমেন্টের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধির সাথে বৈঠক করবেন বলেও জানান।

বিএনপি মহাসচিবের বৈঠকের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সব আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপির কয়েকজন নেতা এখন অভিযোগ করতে জাতিসংঘে গেছেন। এতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা অন্য কারও চাপের কাছে নতিস্বীকার করবো না। গতকাল শুক্রবার ধানমন্ডিতে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের ১০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কারও চাপের মুখে বাংলাদেশ মাথানত করবে না। বাংলাদেশের জনগণ আমাদের চাপ দিতে পারে। বাংলাদেশের সমস্যা আমরা এখানেই সমাধান করবো।

মির্জা ফখরুলের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে ব্যক্তিগত ও ব্যর্থ বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিদেশে যাওয়ার সময় বলে গেলেন জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে তার বৈঠক আছে। ওখানে গিয়ে একজন সহকারীর সঙ্গে বৈঠক করলেন। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেখানে গেছেন। রাজনৈতিকভাবে কতটা দেউলিয়া হলে একটা রাজনৈতিক দলের এ অবস্থা হয়! সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) স্বপ্ন ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক আলোচনা সভায় হানিফ বলেন, বাংলাদেশের জনগণ বিদেশি রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। একইসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের সাক্ষাৎ না পাওয়ায় বিএনপি মহাসচিবের নিউইয়র্ক সফর নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন তিনি।

জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিউইয়র্কে যাওয়ায় সরকার আতঙ্কিত, ঈর্ষান্বিত ও বিব্রত বলে মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ।
জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মওদুদ আহমেদ বলেন, আমাদের দলের মহাসচিব জাতিসংঘে নিজের থেকে যাননি। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের নিমন্ত্রণে গেছেন, দাওয়াতে গেছেন। তারপরও এখানে তারা বলে বসলেন ওখানে নালিশ করতে গেছেন। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমাদের মহাসচিব নালিশ করতে যান নাই, বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরার জন্য গেছেন। দেশে এখন কী অবস্থা বিরাজ করছে এবং বিরোধীদলের ওপরে যে অত্যাচার-নিপীড়ন হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ওপরে যে অত্যাচার-নির্যাতন হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সেই বাস্তব অবস্থা তুলে ধরার জন্য গেছেন।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সারাবিশ্ব জানে বিএনপি মহাসচিব কার আমন্ত্রণে এবং কেন নিউইয়র্কে গেছেন। আওয়ামী লীগের চরিত্র হলো তারা মিথ্যাচার করে প্রতিপক্ষকে ছোট করতে চায়। বাস্তবতাকে মিথ্যার আবরণে ঢাকতে চায়। কিন্তু সব সময় তা সফল হয় না। বিএনপির এই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা অন্য রাষ্ট্রের কাছে গেলে বা বসলে সেটা নিয়ে কোন বির্তক দেখা যায় না, সে সময় অসম্মান হয় না। আর অন্যরা গেলে তাদের গা জ্বালা শুরু হয়, সহ্য করতে পারে না।
দুদু বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে গিয়ে ধ্বর্ণা দিয়েছিল। তাদের এসব বক্তব্যে বোঝা যায় তারা সুস্থ্য ধারার রাজনীতিতে নাই।

জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে মঙ্গলবার রাতে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করেন মির্জা ফখরুল। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় তিনি জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকার সঙ্গে বৈঠক করেন। তার সাথে বিএনপি প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিশেষ দ‚ত হুমায়ুন কবির। বৈঠকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে জাতিসংঘকে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এর সমর্থনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনসহ সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনের তথ্য উপাত্তও তুলে ধরেন।

বিএনপি মহাসচিবসহ বিএনপির প্রতিনিধি দল জাতিসংঘের কাছে বলেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দেশ বা সংস্থা বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে এমনটা তারা চায় না। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত চায় যে, আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমুলক হোক। সকল দলের জন্য সমান সুযোগ থাকবে, ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে এবং তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। এছাড়া বৈঠকে বাংলাদেশে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ, তাকে জামিন না দেয়া, জামিনে বাধার ক্ষেত্রে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ, বিনা কারণে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা, মৃত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা, মানববন্ধন, অনশন কর্মসূচির মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, নেতাকর্মীদের খুন, গুম, নির্বাচনে অনিয়ম, সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমন করা, শিক্ষার্থীসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চিত্রগ্রাহক শহিদুল আলমসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে নির্বিচারে গ্রেফতার, গ্রেফতারের পর রিমান্ডের নামে নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরা হয়।

জবাবে মিরোস্লাভ বিএনপির প্রতিনিধি দলকে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব বর্তমানে ঘানা সফরে আছেন। তিনি নিউইয়র্কে ফিরে আসলে তাকে আলোচনার বিষয়বস্তু অবহিত করা হবে। সূত্র: ইনকিলাব