দক্ষিণ এশিয়ার জন্য চীনা ঋণের ‘নাগপাশ’ সত্যিই কি দুশ্চিন্তার?

আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তি চীন তাদের আর্থিক পরাক্রমকে কাজে লাগিয়ে বহু দেশকে ঋণের নাগপাশে বেঁধে ফেলছে, আমেরিকাসহ বহু পশ্চিমা অর্থনীতিই এই অভিযোগ করে আসছে বহু দিন ধরে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির পরিভাষায় চীনের এই নীতিকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোম্যাসি’ বলেও।

কিন্তু সমস্যা হলো, বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে চীনের এই ঋণের পরিমাণটা ঠিক কত, এই ঋণের শর্তগুলোই বা কী, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও তথ্য বা পরিসংখ্যান পাবলিক ডোমেইনে কখনও তেমন একটা ছিল না। এ জাতীয় তথ্য প্রকাশ করার ব্যাপারে চীনের তেমন সুনাম নেই, ফলে এই কথিত ডেট ট্র্যাপের বহরটা ঠিক কত তাও অজানাই রয়ে গিয়েছিল।

শুধুমাত্র যখন ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে শ্রীলঙ্কার মতো দেশকে হামবানটোটা বন্দর চীনের হাতে তুলে দিতে হয়েছে, কিংবা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে মালয়েশিয়া বাতিল করে দিয়েছে চীনা রেল প্রকল্প, তখনই হইচই হয়েছে চীনের ঋণ নিয়ে। পরে আবার তা চীনের কুশলী কূটনীতিতে থিতিয়েও গেছে।

কিন্তু সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীনের দেওয়া ঋণের সঠিক পরিমাণ কত, সেই তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে নানা বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে। কোথাও সে দেশের সরকার নিজেই তা কবুল করছে, কোথাও আবার অনুসন্ধানী গবেষণায় তা বেরিয়ে আসছে।

এই প্রতিবেদনেও আমরা দেখিয়েছি, পাকিস্তান থেকে শুরু করে মালদ্বীপ, নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে এমনকি ভারত পর্যন্ত কীভাবে চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে এবং কোন দেশ কীভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে।

পাকিস্তান

চীনের ‘অল-ওয়েদার ফ্রেন্ড’ বলে পরিচিত পাকিস্তান গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে, শুধু চলতি আর্থিক বছরেই তারা চীনের কাছ থেকে ৬৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে। গত ১০ মাসে তাদের মোট বৈদেশিক ঋণের যা পরিমাণ, তার তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি এসেছে শুধু চীন থেকেই।

তবে পাকিস্তান এই তথ্য নিজে থেকে প্রকাশ করেনি, আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপেই তাদের এ কথা জানাতে হয়েছে। ইসলামাবাদের পত্রিকা দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানাচ্ছে, আইএমএফের ৬০০ কোটি ডলার বেল-আউট প্যাকেজ পাওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে দেওয়া প্রধান শর্তই ছিল চীনা ঋণের সব শর্ত ও পরিমাণ তাদের প্রকাশ করতে হবে।

এরপরই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আর্থিক উপদেষ্টা ড. আবদুল হাফিজ শেখ এই তথ্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন আরও বলছে, পাকিস্তান তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরেই চীনের দেওয়া আমানতকে সেখানে যোগ করে দেখিয়ে আসছিল। কিন্তু এই প্রথম সে দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক ঋণের পরিসংখ্যানে (ডেট স্ট্যাটিসটিকস) সেটা প্রতিফলিত হলো।

চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর নির্মাণে চীনের দেওয়া ঋণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে এর আগেও প্রতিবাদ হয়েছে, নতুন করে সেই ঋণের ব্যাপকতা সামনে আসার পর সে দেশে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

মালদ্বীপ

ভারত মহাসাগরের এই ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্রেরও চীনের কাছে মোট ঋণের পরিমাণ ১৪০ কোটি ডলারের বেশি। মালদ্বীপের অর্থমন্ত্রী ইব্রাহিম আমিরকে উদ্ধৃত করে গত বছরের ডিসেম্বরে এ তথ্য জানিয়েছে নিক্কে এশিয়ান রিভিউ।

মাসপাঁচেক আগে টোকিও সফরে গিয়ে মালদ্বীপের নতুন অর্থমন্ত্রী আরও জানিয়েছিলেন, এরইমধ্যে তার দেশ প্রায় ৬৭ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে ফেলেছে। অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই (মার্চ ২০১৯) বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে খরচের মাধ্যমে এর পরিমাণ ৮৫ কোটি ডলারে ঠেকবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।

আরও একটা খুব দামি তথ্য প্রকাশ করেছিলেন তিনি, সেটা হলো চীনের দেওয়া ঋণে সুদের হার কত। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, সহজ শর্তে দেওয়া ঋণে চীনের সুদের হার হল ১ দশমিক ৫ থেকে ২ শতাংশ। তবে সভেরেন গ্যারান্টি স্কিমে দেওয়া ঋণগুলোতে সুদের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত।

মালদ্বীপের আর্থিক উন্নয়ন মন্ত্রী ফায়াজ ইসমাইল নিক্কে এশিয়ান রিভিউয়ের কাছে বলেছিলেন, ‘সভেরেন গ্যারান্টির আওতায় নেওয়া ঋণে যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেগুলো আমাদের অর্থনীতিতে কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে, সেটাই আমরা এখন খতিয়ে দেখছি।’

গত নভেম্বরে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ’র নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রাক্কালে ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনে গবেষক রোনক দেশাই এমন কথাও লিখেছিলেন, ‘এই বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধের জন্য মালদ্বীপের ওপর বেইজিংয়ের চাপ এতটাই প্রবল হবে যে, নতুন প্রেসিডেন্ট চাইলেও ভারতের দিকে তেমন একটা ঝুঁকতে পারবেন না!’

শ্রীলঙ্কা

বৈদেশিক ঋণের পাহাড় কীভাবে একটা দ্রুত বিকাশশীল অর্থনীতির চাকাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে, গত কয়েক বছর ধরে শ্রীলঙ্কাকে তার ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা তাদের দক্ষিণ উপকূলের হামবানটোটা বন্দরকে ৯৯ বছরের লিজে চীনের কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হওয়ার পর সেই ধারণাই আরও জোরালো হয়েছে।

সপ্তাহ দুয়েক আগে ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ পত্রিকায় শ্রীলঙ্কান অর্থনীতিবিদ ও গবেষক উমেশ মোরামুদালি লিখেছেন, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের চেহারা আসলে যা ভাবা হচ্ছে, তারচেয়েও অনেক বেশি সাংঘাতিক ও বিপর্যয়কর এবং সেটার জন্য চীনের ঋণ একা দায়ী নয়, বরং এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশি ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ চীনের কাছ থেকে এসেছে।

তিনি আরও জানাচ্ছেন, হামবানটোটা বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে শ্রীলঙ্কা যে ঋণ নিয়েছিল তার জন্য প্রতিবছর যে টাকা শোধ করতে হচ্ছে, সেটা শ্রীলঙ্কার মোট বার্ষিক ঋণ পরিশোধের ৫ শতাংশও নয়। অন্যভাবে বললে, হামবানটোটা আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

বছর দুয়েক আগে বিবিসি’র এক প্রতিবেদনেও জানানো হয়েছিল, শ্রীলঙ্কা সরকারের মোট রাজস্বের ৯৫ শতাংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে, যা থেকে আন্দাজ পাওয়া যায় ওই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের সংকট আসলে কত গভীরে।

প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের আমলেই শ্রীলঙ্কার চীন নির্ভরতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের ভেতর শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশি ঋণের ৬০ শতাংশই এসেছে চীন থেকে, আজ যার চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে দেশটিকে।

নেপাল

নেপালে গত বছর কে পি শর্মা ওলি’র নেতৃত্বে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, চীনের প্রতি তাদের নরম মনোভাবের কথা সুবিদিত। পুরনো বন্ধু দিল্লির দিক থেকে বেশ কিছুটা সরে এসে কাঠমান্ডু যেভাবে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকেছে, তা ভারতকেও সম্প্রতি বেশ বিচলিত করেছে।

নেপাল ও চীনের প্রস্তাবিত যে যৌথ প্রকল্পটির দিকে এখন এই অঞ্চলের নজর কেন্দ্রীভূত, সেটি হলো—ট্রান্স হিমালয়ান রেলওয়ে। বেইজিং থেকে তিব্বতের লাসা (পরে শিতাসে) পর্যন্ত বিস্তৃত রেলপথকেই সম্প্রসারিত করে হিমালয়ের বুক চিরে কাঠমান্ডুতে এনে ফেলাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। আর এর ভালোমন্দকে ঘিরে নেপালের ভেতরেও এখন বিতর্ক তুমুল। কেউ বলছেন এটা নেপালের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেবে, কারও মতে এটা শ্বেতহস্তী হয়েই পড়ে থাকবে।

অস্ট্রেলিয়ার কারটিন ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত নেপালি অর্থনীতিবিদ জগন্নাথ অধিকারী তার এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে (‘দ্য কনভারসেশন’) বলেছেন, চীনের ঋণ তারা আদৌ শোধ করতে পারবে কিনা, এই আশঙ্কার মধ্যেও অনেক ছোট দেশই প্রবল উৎসাহে চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নেপালও তাদের অন্যতম।

প্রধানমন্ত্রী ওলি গত বছরের জুনে বেইজিং সফরে গিয়ে চীনের সঙ্গে ২৪০ কোটি ডলার মূল্যের আর্থিক সমঝোতায় সইও করে এসেছেন, যার মধ্যে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র অনেক কিছুই আছে।

ট্রান্স হিমালয়ান রেলওয়ে (যা বেল্ট রোডেরই অংশ) বাস্তবায়নে চীন পুরো টাকাটা অনুদান হিসেবেই দিক, প্রধানমন্ত্রী ওলি এখন সেটাই চান। তবে চীন বলছে, তারা খুব সহজ শর্তে ঋণ দিতে পারে, কিন্তু অনুদান নয়। এই জটটা খোলেনি বলেই এখনও ওই রেলপথ নির্মাণের কাজও থমকে আছে।

গবেষক জগন্নাথ অধিকারীর কথায়, ‘নেপালের পরিণতি যাতে শ্রীলঙ্কার মতো না হয়, সেজন্য খুব সাবধানে তাদের পা ফেলতে হবে। নেপালও চীনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে কিনা, সেটা বোধহয় আমরা খুব শিগগিরই টের পাবো।’

বাংলাদেশ

গত ১১ মে বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদনেই প্রথম জানানো হয়েছিল, বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে চীনের কাছ থেকে এরমধ্যেই ৫৭০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

এই ঋণের অর্থে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পদ্মা ব্রিজ রেলওয়ে লিংক, দাসেরকান্দি স্যুয়ারেজ লাইন, কর্ণফুলীর নিচে টানেল, টেলিকম খাতের আধুনিকীকরণ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং ঝু দাবি করেছেন, বাংলাদেশ বা কোনও দেশকেই ঋণের ফাঁদে ফেলা তাদের লক্ষ্য নয়। ‘আমরা সবাইকে সহযোগিতারই চেষ্টা করছি, কাউকেই ডেট ট্র্যাপে ফেলতে চাইছি না’, বলেছেন তিনি।

এর আগে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ২০১৬-এর অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, তখন দ্বিপাক্ষিক স্তরে প্রায় ২৬ কোটি ডলারের আর্থিক সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অনেক দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমেই তখন লেখা হয়েছিল, ‘ঢাকায় এসে কার্যত ব্ল্যাংক চেক লিখে দিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট শি’।

তবে চীনের আর্থিক সহায়তা যে মোটেই অনুদান ছিল না, বরং তার বেশিরভাগটাই আসলে মোটামুটি সহজ শর্তে ঋণ, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরাও এক্ষেত্রে ‘দেখেশুনে পদক্ষেপ নেওয়ার’ পক্ষেই মত দিয়েছেন।

ভারত

বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে চায় যে ভারত, সেই দেশটিও কিন্তু চীনের স্পনসর্ড এশিয়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।

চীনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গৌতম বাম্বেওয়ালা গত জানুয়ারিতেই এআইআইবি’র প্রেসিডেন্ট জি লিকুনের সঙ্গে (যিনি আগে চীনের সহকারী অর্থমন্ত্রীও ছিলেন) দীর্ঘ বৈঠক করেন। সেই বৈঠকের পরই জানানো হয়, গত বছরই ভারত ওই ব্যাংক থেকে দেড়শ’ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে, আরও তিনশ’ কোটি ডলার পাইপলাইনে আছে।

ফলে এআইআইবি’র ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর মধ্যে ভারতই শীর্ষে। ভারতের বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প রূপায়ণেই এই অর্থ খরচ হচ্ছে, চলতি মাসে মুম্বাইতে ওই ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনেও ভারতকে আর কী কী ঋণ দেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে।

ভারত অবশ্য দাবি করে থাকে, যদিও এআইআইবি’র প্রধান স্পনসর হলো চীন, কিন্তু এটি কোনও চীনা ব্যাংক নয়। কাজেই এআইআইবি থেকে নেওয়া ঋণকেও ভারত ‘চাইনিজ ডেট’ বলতে রাজি নয়।

বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবেই বছর কয়েক আগে চীন এই এশিয়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল। এআইআইবি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ব্রিটিশ কেবিনেট মন্ত্রী ড্যানি অ্যালেক্সান্ডার বহুবার বলেছেন, ‘আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন এটা কি একটা চীনা ব্যাংক? আমি তাদের সবসময় বলি এটা একটা বহুপাক্ষিক (মাল্টিলেটারাল) ব্যাংক, আর অন্তত ৮৪টি দেশ এর সদস্য।

কিন্তু চীন যেহেতু এই ব্যাংকের মূল প্রতিষ্ঠাতা ও অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত, তাই এআই আইবি থেকে নেওয়া ভারতের বিপুল ঋণকেও অনেক বিশেষজ্ঞই চীনের দেওয়া ঋণ হিসেবেই দেখে থাকেন।

উপসংহার

ওপরের তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে মোটামুটি পরিষ্কার, দক্ষিণ এশিয়ার ছোট-বড় প্রায় সব দেশেরই যথেষ্ট পরিমাণে চীনের ঋণ নেওয়া আছে। কারও পরিমাণ কিছুটা কম, কারও বেশি। সংকটের মাত্রাতেও ফারাক আছে।

দিল্লির থিংকট্যাংক রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজে অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবে যুক্ত অর্থনীতিবিদ ড. প্রবীর দে বহুদিন ধরে চীনের দেওয়া বৈদেশিক ঋণ ও তার প্যাটার্ন নিয়ে গবেষণা করছেন।

ড. দে বলছিলেন, ‘এটা সবার জন্য ট্র্যাপ বা ফাঁদ হবে কিনা বলা মুশকিল। তবে বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অনেক ছোট দেশই চীনের দেওয়া অর্থকে প্রথমে গ্র্যান্ট বা অনুদান হিসেবে ধরে নেয়। তারা মনে করে, চীন বিনা পয়সায় বেল্ট রোডের আওতায় তাদের দেশেও কিছু অবকাঠামো বানিয়ে দেবে।’

কিন্তু আসলে এখানে ‘ফ্রি লাঞ্চ’ বলে কিছু হয় না। চীনের ঋণে সুদের হার হয়তো ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের চেয়েও কিছুটা কম, কিন্তু একেবারে শূন্য তো নয়। কাজেই ছোট উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে অতি সতর্ক থাকতেই হবে, বিশেষ করে যেসব দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের সমস্যা আছে।

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও বলেছেন, ‘চীনের ঋণ যেন ওপেন টিকিট না হয়ে যায়, সেটা আমাদের দেখতে হবে। অর্থাৎ যেনতেন প্রকল্পে যেন ঋণ না নেওয়া হয়, সেটা নিশ্চিত করাটা জরুরি।’

কী শর্তে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, সুদের হার কী এবং সেটা যেন খুব চড়া না হয়, সে বিষয়েও তিনি সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সঙ্গেই তিনি আরও বলেছেন, রফতানিমুখী খাতে সহায়তা দেবে যেসব প্রকল্প, সেখানে ঋণ নিলেই ভালো। কারণ, রফতানি থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রায় চীনের ঋণ পরিশোধও তুলনায় সহজ হবে।

ফলে একদিকে বিগ-টিকিট উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের হাতছানি, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া ঠেকানো, এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বিধান করেই চীনা ঋণ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন