ঘোপের শহীদ ওহাব আলীর পরিবারের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

বহিরাগত হিসেবে কখনোই যশোরের দায়িত্বরতদের মনের মানুষ হতে পারেননি। এ কারনেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও তালিকায় নাম নেই ওহাব আলীর। তার পিতা বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর থেকে ষাটের দশকে যশোরে চলে আসেন। এটাই যেন কাল হয়েছে তার বিবেচনায়। এখন এই পরিবারের দাবি প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাদের ওহাব আলীর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাক। এই আশায় পরিবারের সকল সদস্য বুক বেঁধেছেন। যশোরের মতই বৃহত্তর ফরিদপুরের মানুষ ওহাব আলীর বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির অপেক্ষায়।

বর্তমান মাদারিপুর জেলার সদর উপজেলার শিবখাড়া গ্রামে জন্ম ওহাবের পিতা মফিজউদ্দীন ঢালীর। তার দাদা ওছিমউদ্দীন ঢালীর বাড়িটি ছিল ঐতিহ্যবাহী আঁড়িয়াল খা নদী গাঁ ঘেষে। বনেদী একটি পরিবার। মফিজ উদ্দীন ঢালী যশোরে এসে বিয়ে থা করে শহরের ঘোপে বসবাস শুরু করেন। ওহাব ইপিআরের সহযোগী হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। অত:পর শহীদ তা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম ওঠেনি যশোর শহরের ঘোপের ওহাব আলীর। আরবপুর এলাকায় পাকিস্থানী সেনাদের আক্রমন করতে গিয়ে হানাদার বাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে অনেকের সাথে করুণ মৃত্যুবরণ করেন এই অকূতোভয় বীর তরুন মুক্তিযোদ্ধা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার ছোট ভাই ওহাব আলীর দাবি ভাইয়ের নামটি যেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়। তাতে তার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যে যায়নি তা প্রমান হবে এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার যথাযথ মূল্যায়ন হবে। মাইক্রো চালিয়ে জীবনযাত্রায় ব্যস্ত এই মানুষটি তার ভাইয়ের অর্জনকে মুছে যেতে দিতে নারাজ।

সহযোগীদের বর্ননামতে যশোর শহরের ঘোপ জেল রোডের মফিজ ঢালীর পুত্র ওহাব আলী বয়সে তখন ১৪/১৫ বছরের তরুণ। ২৫মার্চ রাতে সারা দেশে পাকিস্থানী খান সেনাদের অতর্কিত হামলায় সারা দেশে যখন হতাহতের ব্যাপকতায় চরম অবস্থা। চারিদিকে লাশ আর লাশ সেই সঙ্কটময় মুহুর্তে বাবাকে শহরে রেখে মা, ভাই বোন সহ অনেকেই সদরের হাশিমপুর এনায়েতপুর এলাকায় চলে যান। ২৬ মার্চ দিনেই তিনি ফিরে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখান। যশোর জিলা স্কুলের পূর্ব পাশে বর্তমানের নব কিশলয় স্কুল এলাকায় তখন ইপিআর হেড কোয়াটার্স অবস্থিত ছিল। তিনি ইপিআরের সহযোগী হিসেবে মুক্তি বাহিনীর তালিকায় নাম লেখান। ইপিআর, পুলিশ, আনছার ও মুক্তি বাহিনীর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুসারে ১লা এপ্রিল সকালে আরবপুরস্থ খান সেনাদের ব্যারাকে হামলার প্রস্ততি নেওয়া হয়। এদিন দুপুর নাগাদ দুটি মিনি ট্রাক বা পিক আপে করে মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের জন্য রুটিসহ বিভিন্ন খাবার, পানি, অস্ত্র গোলা বারুদ ভরে যাত্রা শুরু হয় ইপিআর হেড কোয়াটার্স থেকে। সামনের মিনি ট্রাকে ছিলেন দুই জন ইপিআর সদস্য, জেলা পরিষদের জামাল, ঘোপের ওহাব আলী। এ মিশনে ছিলেন খান টিপু সুলতান, জাসদের রবিউল আলম, ঘোপের আব্দুল হাই, পুরাতন কসবা চুয়াডাঙ্গা বাস ষ্ট্যান্ডের এ্যাডভোকেট কাজী আব্দুস শহীদ লাল, বুক প্যালেসের মানিক। কারবালা কবরস্থানের উত্তর পাশ এলাকায় পাকিস্থানী মর্টার শেলের আঘাতে সামনের মিনি ট্রাক লন্ড ভন্ড হয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন দুই ইপিআর সদস্য, গাড়ির ড্রাইভার, ওহাব আলী, আওলাদ সহ আরো দুই জন। ২০০ গজ দুরে তখন অসহায় অবস্থায় এদৃশ্য দেখেন বাবলু, যশোর শহর ছাত্রলীগের সভাপতি এম এ জিন্নাহ, মোসাদ্দেক, পোষ্ট অফিস পাড়ার ছাত্রলীগ নেতা খুরশিদ আনোয়ার বাবলু প্রমুখ। দুই জন বাদে মৃত অন্যদের ছিন্ন ভিন্ন লাশ কারবালা কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওহাব আলীর লাশ ও অন্য একজনের লাশ ফাতেমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তার পিতা লাশটি নিয়ে যান। তাকে ঘোপে সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের বাড়ির পিছনে হেফজখানা সংলগ্ন কবরস্থানে তার পিতা একাই দাফন করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টেট বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খুরশিদ আনোয়ার বাবলু জানান, তারা পাকিস্থানী হানাদারদের তীব্র হামলার মুখে পিছনের মিনি ট্রাকসহ পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। তবে ওহাব আলীদের মিনি ট্রাক তাদের চোখের সামনে মর্টার শেলের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ঐ গাড়ির সকলেই করুণ মৃত্যুবরণ করেন। ইপিআর, আনছার, পুলিশ ও সাধারন মানুষ মিলে মুক্তিবাহিনী করেছিলাম। ওহাব আলী আমার বন্ধু হিসেবে ইপিআরের সহযোগী হিসেবে মুক্তি বাহিনীতে নাম লেখায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপিং লবিংয়ে পড়ে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহাব আলী আজো বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অনুপস্থিত। এখানে দায়িত্বরতরা বহিরাগত বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম কখনোই দেয়নি।

শহীদ ওহাব আলীর ভাই সাহেব আলী বলেন, আমার জন্মের দুই মাস আগে, পিতা-মাতা ও ভাইবোনকে ওহাব ভাই ২৬মার্চ সকালে এনায়েতপুরে রেখে চলে আসে। তার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। পরে জেনেছি পাকিস্থানী সেনাদের মর্টার শেলে সে মারা গেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরে, সে সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শহীদ ওহাব আলীর জন্য ২০০০ টাকা ও সনদপত্র তাদের দেন। তবে সনদপত্রটি আজ আর নেই। এখন তারা অপেক্ষায় আছেন যদি প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের তালিকা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সরকার করে তাহলে সেখানে নিশ্চয় তার ভাই ওহাব আলীর নাম থাকবে। কেননা এত বড় সত্য ও ইতিহাস কখনো লুকিয়ে রাখা যাবেনা। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে তারা দাবি জানাচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যেন ওহাব আলীর নাম তালিকাভ্ক্তূ হয়।

শহীদ ওহাব আলীর ছোট ভাই সাহেব আলী বলেন, তার ভাইয়ের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা (অর্ন্তভূক্তি) তে ৩২৩ নাম্বার সিরিয়ালে ছিল। যশোর পৌরসভার বীর মুুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা যা চূড়ান্ত করনের ইউনিয়নওয়ারী তালিকায়ও তার নাম ছিল ৫৩ নাম্বার সিরিয়ালে। যশোরের জেলা প্রশাসক (স্বাক্ষর অস্পষ্ট), বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের যশোর জেলা ইউনিট কমান্ড এর আহ্বায়ক নুরুল ইসলাম, যশোর সদর উপজেলা কমান্ডের আহ্বায়ক বাবর আলী, যশোর সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের স্বাক্ষরিত সে তালিকাও বাস্তবায়ন হয়নি। এখন আমরা চাই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যেন আমার ভাই ওহাব আলীর নামটি তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়। জাতির গৌরবময় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েও ওর নাম কেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় থাকবেনা তা আমাদের বোধগম্য নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের একটাই দাবি আমার বড় ভাই ওহাব আলীর নামটি সঠিক ও যাচাইয়ের মাধ্যমে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করা হয়। আমার ভাইয়ের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের সেই ইতিহাস যেন মুছে না যায়।