বিটিআরসির ক্ষমতা পাচ্ছে ডট!

btrc

বিদ্যমান আইনে স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসির। সেই আইন সংশোধনের আগেই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর বা ‘ডট’কে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এটি করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিটিআরসির দায়িত্ব ও এখতিয়ারের আরো বেশ কিছু বিষয় ওই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ তাদের অধীন ওই প্রতিষ্ঠানকে অর্পণ করেছে। সর্বোপরি আইন সংশোধন করে স্বাধীন এই কমিশনের স্বাধীনতাই কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ গত অক্টোবরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ সংশোধনের খসড়া প্রস্তুত করে। তাতে ‘একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে লেখা হয় ‘সরকারের একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা’। ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’ বাদ দিয়ে লেখা হয়েছে ‘সরকারের একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’। বিদ্যমান আইনের ২১ ধারায় টেলিযোগাযোগ খাত থেকে আয় বিটিআরসির নিজস্ব তহবিলে জমা রাখার বিধান রয়েছে। তা সংশোধন করে সরকারি কোষাগারে জমার বিধান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এর আগে ২০১০ সালে আইন সংশোধন করে বিটিআরসির ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করা হয়। ২০০১ সালে প্রণীত টেলিযোগাযোগ আইনের প্রস্তাবনায় বলা ছিল, ‘যেহেতু বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও দক্ষ নিয়ন্ত্রণ এবং টেলিযোগাযোগ সেবা নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা, কার্যাবলি ও দায়িত্ব কমিশনের কাছে হস্তান্তর এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান করা সমীচীন, সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল।’

২০১০ সালে মূল আইন সংশোধন করে প্রস্তাবনা অংশে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ‘ক্ষমতা’ পরিবর্তন করে ‘কতিপয় ক্ষমতা’ করা হয়। আর সর্বশেষ উদ্যোগে ‘স্বাধীন’ শব্দটিই বিলুপ্ত করাসহ বেতার ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ, এর ব্যবহারের কর্তৃত্ব প্রদান, বেতার ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের পরিবীক্ষণ ও স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনায়ও

সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিধান করার প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু সংসদে পাসের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে সে বিধান যুক্ত হওয়ার আগেই স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরকে কেন দেওয়া হলো সেই প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো জবাব মিলছে না।

গত ১০ ডিসেম্বর উপসচিব এস এম তারিক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের (চ) অনুচ্ছেদে ডট-এর ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুসারে টেলিযোগাযোগ খাতে জাতীয় সম্পদসমূহের (যেমন : স্পেকট্রাম, নাম্বারিং, ল্যান্ডিং রাইটস, স্পেস অরবিট ইত্যাদি) অর্জন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমন্বয় এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ও পরিবীক্ষণ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা।’ কিন্তু বিদ্যমান টেলিযোগাযোগ আইনে বিটিআরসির ক্ষমতা সম্পর্কিত বিধানের ৩১ ধারার (২ঈ) উপধারায় বলা হয়েছে, বিটিআরসি বেতার ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ, এর ব্যবহারে কর্তৃত্ব প্রদান, বেতার ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার পরিবীক্ষণ ও স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনা করবে।

মূল আইনের ৩১ ধারায় কমিশনের ক্ষমতা বিষয়ে বলা ছিল, কমিশন টেলিযোগাযোগ সেবা বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স প্রদান ও তা বাতিল করা, বেতার ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ, টেলিযোগাযোগ সেবার ট্যারিফ, কলচার্জ নির্ধারণ—ইত্যাদি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। ২০১০ সালে আইন সংশোধন করে এই ক্ষমতা আংশিক খর্ব করে লাইসেন্স দেওয়া, লাইসেন্স হস্তান্তর বা বাতিল করার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বিধান করা হয়।

মূল আইনের ১ ধারায় আইনটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন’। ২০১০ সালে তা পাল্টে করা হয় ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন’। সর্বশেষ গত অক্টোবরে শিরোনাম থেকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটি বাদ দিয়ে আইনের খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করা হয়।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ বিষয়ে গত সোমবার বলেন, ‘২০ বছরের পুরনো টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। বাস্তবতার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের সংশোধনী খসড়া প্রস্তুত। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য তা দ্রুতই পেশ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘বিটিআরসির যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব রয়েছে সেগুলো থাকবে। ডট অধীন অধিদপ্তর হিসেবে এসব বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে সহযোগিতা করবে। এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই।’

বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, প্রজ্ঞাপনটি এখনো দেখিনি। এটা পর্যালোচনা দরকার। এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের সঙ্গে কথা বলব। স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্টের জন্য বিটিআরসির দক্ষ জনবল রয়েছে। আইনগতভাবেও এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিটিআরসির। ডটকে এই দায়িত্ব দিলে ওভারল্যাপিংয়ের ঘটনা ঘটবে।

প্রসঙ্গত, বিলুপ্ত হওয়া সরকারি টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বিটিটিবির জনবলের চাকরির ধারাবাহিতা রক্ষা, বিটিসিএলকে পূর্ণাঙ্গ কম্পানি হিসেবে পরিচালনা এবং টেলিযোগাযোগসংক্রান্ত নীতি প্রণয়নে সরকারকে কারিগরি, বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে ২০১৫ সালে টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর বা ডট সৃজন করা হয়। প্রথম দিকে এর যে কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয় সেটিও ছিল বিটিআরসির ক্ষমতা ও দায়িত্বের সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক।