দেড় লাখ টাকায় নকল এনআইডি

দালালদের একটি চক্র এবং নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বছরের পর বছর ধরে তৈরি করে আসছেন নকল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। এনআইডি ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারির অভাব এবং ফাঁক-ফোকর থাকায় নকল কার্ড তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে বলে উঠে এসেছে পুলিশের তদন্তে।

নকল এনআইডি কার্ড বিক্রি করা হয় এক লাখ ২০ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এগুলো মূলত ব্যবহার করা হয় ব্যাংক ঋণ ও জমি জালিয়াতির কাজে।

একাধিক এনআইডি প্রদান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও এই চক্র নাম ও ছবি একই রেখে অন্যান্য তথ্য পরিবর্তন করে নকল কার্ড তৈরি করে।

যাদের আসল এনআইডি আছে তাদের কাছেই এসব নকল কার্ড বিক্রি করা হয়। এসব কার্ডের বেশিরভাগই ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির জন্য ব্যবহার করা হয়।

এ ছাড়াও, জমি সংক্রান্ত জালিয়াতির জন্য ছবি পরিবর্তন করে নকল এনআইডি কার্ড তৈরি করে এই চক্র।

নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখা এমন অন্তত এক হাজার ৫৭ জনকে শনাক্ত করেছে, যারা দ্বিতীয়বার এনআইডি কার্ড পেয়েছেন। এই উইংয়ের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের আইনি শাখার মাধ্যমে এই কার্ডধারীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫৫৬টি মামলা করেছেন এবং কার্ডগুলো ব্লক করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর বলেন, ‘এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে এনআইডি শাখার প্রায় ৪২ জন কর্মচারীকে আমরা বরখাস্ত করেছি।’

চক্র

নকল এনআইডি সরবরাহে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) রাজধানীর মিরপুর থেকে দুজন নির্বাচন কমিশন কর্মচারীসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে।

ডিবি তাদের কাছ থেকে ১২টি নকল এনআইডি কার্ড উদ্ধার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা এই চক্রের আরও চার জনের নাম জানায়, যাদের মধ্যে দুজন লালমনিরহাটে নির্বাচন কমিশন অফিসে কর্মরত।

ডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই চক্রের সদস্যরা একটি নকল এনআইডি কার্ড সরবরাহের জন্য দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নেন।’

এনআইডি শাখায় নকল কার্ড তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা কার্ড প্রতি ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা নেন বলে এই কর্মকর্তা গত ২২ ডিসেম্বর জানান।

খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা নতুন গ্রাহক হিসেবে ব্যাংক ঋণ নিতে এমন নকল কার্ড ব্যবহার করে।

ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেউ যদি ঋণ পাওয়ার অযোগ্য বলে ঘোষিত হন, ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি চক্রের সদস্যরা তাদের নিয়ে যায় নির্বাচন কমিশনের চক্রের কাছে। সেখানে তৈরি করা হয় নকল এনআইডি।

নকল কার্ড ব্যবহার করে ঋণ পাওয়ার পর এই চক্রগুলো তাদের কমিশন পায়।

তদন্তের সঙ্গে জড়িত ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, তারা এমন চক্রের সহায়তায় ইতোমধ্যে গত এক বছরে নকল এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক থেকে ১৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন।

তদন্তের সমন্বয়কারী ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস বলেন, ‘আমরা সিআইবির প্রতিবেদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছি। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর, যারা নকল নথি দিয়ে ঋণ নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করব।’

গত ২২ ডিসেম্বর এনআইডি শাখা এক দালালকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) কাছে হস্তান্তরিত করে। একজন এনআইডি কার্ডধারীর বয়স ১০ বছর কমানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি।

গ্রেপ্তারকৃত বাহাদুর দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে নুর জালাল শেখ নামে একজনের বয়স কমিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

নূর জালাল জানান, চাকরি স্থায়ী করার জন্য তার বয়স ১০ বছর কমানো খুবই দরকার। তাই তিনি বাহাদুরকে এই কাজ দেন এবং ইতোমধ্যে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকাও দিয়ে দিয়েছেন বাহাদুরকে।

৩০ আগস্ট জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর নামে দ্বিতীয় এনআইডি কার্ড থাকায় মামলা করে নির্বাচন কমিশন।

এনআইডি কার্ড জালিয়াতির সবচেয়ে বড় ঘটনা প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। রোহিঙ্গাদের জন্য এনআইডি কার্ড তৈরির কারণে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

এনআইডি শাখার মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘যারাই এই চক্রের সদস্য হোক না কেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অপরাধ তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিটি আছে এবং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশন ব্যবস্থা গ্রহণ করে।’

তিনি বলেন, ‘এ জাতীয় অপরাধ বন্ধ করতে নতুন এনআইডি কার্ড নেওয়ার সময় নাগরিকদের চেহারা এবং আইরিস স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক করার কাজ চলছে।’

এনআইডি শাখার কর্মকর্তারা বলেন, ‘সার্ভারে যেকোনো এনআইডি ফাইলের ইনপুট দেওয়ার জন্য দায়িত্বরত কর্মীদের এখন প্রতিটি ফাইলে তথ্য যোগ করা বা পরিবর্তন করার সময় প্রতিবার তাদের ডিজিটাল সই করতে হয়।’

সম্প্রতি কর্মচারী গ্রেপ্তার হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনে রদবদল করা হয়েছে।

সূত্র : দি ডেইলি স্টার