তলোয়ার নিয়ে এলে রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিলেন সিইসি

নির্বাচনের সময় কেউ তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ালে প্রতিপক্ষকে রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে সংলাপে তিনি এমন পরামর্শ দেন।

কমিশনের সদস্যরা আমোদ ফুর্তি করতে দায়িত্ব নেননি-এমন মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘কঠিন দায়িত্ব নিয়ে এসেছি কঠোর পরিশ্রম করছি। আমরা সহিংসতা বন্ধ করতে পারবো না। আপনাদেরকেও (রাজনৈতিক দলের) দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ খেলোয়াড় কিন্তু আপনারা। আপনারা মাঠে খেলবেন, আমরা রেফারি। আমাদের অনেক ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা কিন্তু কম না, ক্ষমতা প্রয়োগ করবো।’

যেকোনো পরিস্থিতিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন পদত্যাগে প্রস্তুত রয়েছে উল্লেখ করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘অনেকে হয়তো ভয় পাচ্ছে, নতুন করে সরকার হলে তার একটা শর্ত থাকবে। এজন্য আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই- এখানে সামান্যতম কোনো ভয়-ভীতি নেই বলার আগেই পদ ছেড়ে দেব। যদি সত্য হয় নতুন কোনো যোগ্য নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে-তাহলে আমাকে আহ্বান করতে হবে না। আমি চাই সম্প্রীতি, আমি চাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য, সমঝোতা। আমাকে দিয়ে না হোক, যে কাউকে দিয়ে হতে পারে। নির্বাচনের স্বার্থে যদি আমাকে পথ থেকে সরে যেতে হয় তাহলে আমাকে রিকোয়েস্ট করতে হবে না। রিকোয়েস্ট করার আগেই চলে যাব। এই পদে কিন্তু আমরা আমোদ-ফুর্তি করতে আসিনি। কঠিন দায়িত্ব নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে এসেছি এবং কঠিন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। এর জন্য আপনাদের সহযোগিতার সব সময় কামনা করছি।’

তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচন আমাদের ওপর চাপাবেন না, ১৮ সালের নির্বাচনের দায় আমাদের ওপর চাপাবেন না। আমরা আমাদের নির্বাচনের দায় আমরা বহন করবো। নির্বাচনটাকে অংশগ্রহণমূলক করতে আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করবো এবং নিরপেক্ষতা করতে। সবদলগুলো সহযোগিতা না করলে আমরা সেখানে ব্যর্থ হয়ে যাবো। আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌঁড় দেন, তাহলে আমি কি করবো? কাজেই আমরা সাহায্য করবো। পুলিশের ওপর, সরকারের ওপর আমাদের কমান্ড থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের সময় যেটি থাকবে সেটি কিন্তু সরকার। আমি বারবার বলেছি, রাজনৈতিক দল আর সরকার এক নয়। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। কিন্তু যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, তখন তিনি সরকার প্রধান, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নয়। এটি বুঝতে হবে। আমরা সরকারের সাহায্য চাইবো। সরকার যদি সহায়তা না করে, তাহলে নির্বাচনের পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।’

এর আগে স্বাগত বক্তব্যে সিইসি বলেন, ‘যে সব রাজনৈতিক দল বিশেষত প্রধানতম দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়া খুবই প্রয়োজন। কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অবশ্যই বাধ্য করতে পারবো না। তবে সব দলকে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে আমরা বারবার আহ্বান করে যাবো। সে প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত থাকবে।’

সিইসি বলেন, ‘আজকেও আপনাদের মাধ্যমে সকল দলকে আহ্বান জানাচ্ছি সক্রিয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা না থাকলে জনমতের সঠিক প্রতিফলন হয় না। পক্ষ-প্রতিপক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাঠ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সম্ভাব্য অনিয়ম, কারচুপি, দুর্নীতি, অর্থ শক্তির বৈভব ও পেশি শক্তির প্রয়োগ ও প্রভাব বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। নির্বাচন কমিশন সকলের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করতে চায়। অন্যথায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের প্রয়াস যতই আন্তরিক হোক, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সেটা কাম্য নয়।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। একটি মাত্র দল ৩০০টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সাংবিধানিকভাবে কোনো বাধা নেই। তবে ইতিহাস বলে সেক্ষেত্রে অচিরেই গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হবে। স্বৈরতন্ত্র মাথা জাগিয়ে তুলবে। গণতন্ত্রের আরাধ্য পুনরুদ্ধার হয়ে পড়বে দুরূহ।’

সিইসি বলেন, ‘আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নানাবিধ আশা, হতাশা ও তর্ক-বিতর্ক চলছে। বিতর্কগুলো নিরসন হওয়া প্রয়োজন। ইতিপূর্বে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা কয়েটি উন্মুক্ত সংলাপ করেছি। এতে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। কমিশনের সক্ষমতা ও সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা নির্ধিদায় তা স্বীকার করে নিয়ে কারণগুলো বারবার ব্যাখ্যা করে বলেছি। ইভিএম নিয়ে পাঁচ-সাতটি কর্মশালা করার পর আমরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এবং বিষেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত সভা করেছি। কেউ কোনো ত্রুটি দেখাতে পারেনি। ইভিএম এবং ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আরপিও ২৬ অনুযায়ী, কারচুপির বিধান উলে­খ করা হয়েছে।’ সেগুলো প্রতিপালন করা হলে কারচুপি প্রতিরোধ করা সম্ভব বলেও জানান সিইসি।

এতো কিছুর পরেও অপপ্রচার সমানে চলছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘ইভিএম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সংশয় থেকেই যাচ্ছে। আমরা সত্যি উদ্বিগ্ন হচ্ছি। কেন্দ্রে কেন্দ্রে অনিয়ম, সহিংসতা, ব্যালট পেপার ছিনতাই হলে প্রতিরোধ কতটা সম্ভব হবে। আমাদের প্রত্যাশা জাতীয় নেতৃবৃন্দ ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে নিবিড়ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা ও মতৈক্য হয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর নিরসন করে আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য অনকূল পরিবেশ ও সমতল ভিত্তি সৃষ্টি করবেন।’

তিনি বলেন, ‘অরাজনৈতিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিগত সংগঠিত হয়ে এগিয়ে এসে জাতির একটি সংকটময় মূহুর্তে তাদের প্রজ্ঞা ও জ্ঞান প্রয়োগ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সংলাপে আহ্বান করে আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক মতৈক্য সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারেন। আমরা নির্বাচন করতে চাই অনুকূল পরিবেশ ও শক্ত ভিত্তির ওপর। এজন্য সকলের সহায়তা কাম্য।’

সিইসি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক সমঝোতা ঐক্যমত্য খুবই প্রয়োজন। আমরা দেখছি একটি বড় ঐক্যমত্য একদিকে। আরেকদিকে সরকার। আমরা খুবই দ্বিধান্বিত হই যখন তাদের বক্তব্যগুলো সাংঘর্ষিক হয়। আমরা চাই সমঝোতা করে এগিয়ে যাক।’

সিইসির বক্তব্যের পাল্টা জবাবে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘আমরা কেউ শটগান নিয়ে আসতে পারি না, কারণ আইন আমাদের পারমিট করে না। অন্য কেউ যদি পিস্তল নিয়ে আসে বা ১০০ জন মানুষ নিয়ে আসে সেটা সরকারি ফান্ড থেকে ট্যাকেল করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চয়তা দিতে হবে প্রশাসন নিউট্রাল থাকবে।’

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয়তাবাদী গণতান্তিক আন্দোলন-এনডিএম এর সঙ্গে সংলাপে বসে কমিশন। এই সংলাপ ধারাবাহিকভাবে ৩১ জুলাই পর্যন্ত চলবে।

এ সময় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এনডিএম এর সঙ্গে সংলাপের পর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট বিএনএফের সঙ্গে সংলাপ শুরু করে ইসি।