বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক, আশায় বুক বেঁধেছেন চা শ্রমিকরা

 

চা শ্রমিকদের নজিরবিহীন আন্দোলনে এ শিল্পে বিরাজ করছে অচলাবস্থা। এত দিনেও দাবি পূরণ না হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়ে চলেছে। অচলাবস্থা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন শ্রমিকরা। তাঁর সিদ্ধান্ত পেলেই কাজে যোগ দেবেন তাঁরা।

 

শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে চা বাগান মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকের পর শ্রমিকদের কর্মবিরতি শেষ হতে পারে বলে অনেকেই আশাবাদী। শুক্রবার বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান এম শাহ আলম সমকালকে বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমরা সেখানে যাব। তার আগে এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নেব।’ বিকেল ৪টায় গণভবনে এই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

 

 

তবে গতকাল পর্যন্ত শ্রমিক পক্ষকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। যোগাযোগ করা হলে আন্দোলনরত শ্রমিকদের নেতা সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা গতরাতে সমকালকে বলেন, ‘আমরা এখনও কোনো আমন্ত্রণ পাইনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি আমরা। সেই সঙ্গে আশা করছি, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শ্রমিকরা তাঁদের ন্যায্য সমাধান পাবেন।’

 

 

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করার দাবিতে কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করছেন মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার ২৪১টি চা বাগানের শ্রমিকরা। প্রথমে ৯ আগস্ট থেকে চার দিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি শুরু করেন তাঁরা। এর পর ১৩ আগস্ট থেকে চা শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করছেন। স্থানীয়ভাবে সমঝোতায় শ্রমিকদের কাজে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। পরে সচিবালয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বৈঠক হয় কয়েক দফা। কিন্তু তাতেও কোনো সুরাহা হয়নি।

 

জ্বলছে না চুলা :এদিকে আন্দোলনের কারণে শ্রমিকদের ঘরে চুলা আর জ্বলছে না। বাগান কর্তৃপক্ষ বর্তমান হারে রেশন দিতে চাইলেও আন্দোলনরত শ্রমিকরা রেশন গ্রহণ করেননি। এমনকি দৈনিক মজুরির টাকাও তাঁরা নিচ্ছেন না। ফলে অনেক পরিবারে খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। খেয়ে না খেয়ে আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা।

 

গতকাল শুক্রবার কোনো বিক্ষোভ কর্মসূচি না করলেও যথারীতি কর্মবিরতি পালন করেন তাঁরা। শ্রমিকরা ১৭তম দিনেও অনড় অবস্থানে রয়েছেন। শ্রমিক নেতারা কর্মবিরতি চালিয়ে যেতে বাগানে বাগানে ও ভ্যালিতে সভা, সমাবেশ ও বিক্ষোভ করে যাচ্ছেন।

 

চা কারখানা বন্ধ থাকায় কারখানায় সংগ্রহ করা কাঁচা চা পাতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। বাগানের ভেতরে চা গাছের উপরিভাগ লম্বা হয়ে সংগ্রহ করার অনুপোযোগী হয়ে গেছে। প্রতিদিন বাগানে লোকসান হচ্ছে বলে মালিকরা জানান। লাক্কাতুরা চা বাগানের এক কর্মকর্তা জানান, তাঁদের বাগানের চারদিকে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাটে ময়লা জমে আছে। দিনেও ভয় লাগে হাঁটতে। আরও কিছুদিন এভাবে চললে চা বাগান মালিকদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে।

 

চা শ্রমিকরা জানান, তাঁদের খবর কেউ রাখে না। শ্রমিকরা কেমন আছে জানতে চায় না; তাঁদের সন্তানরা খেয়ে আছে নাকি না খেয়ে আছে একবারও খবর নেয়নি। মালিক পক্ষের লোকজনও কোনো খবর নেয়নি। তবে দু-একটি বাগানে ব্যতিক্রম আছে বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা। এসব বাগানের মালিকরা শ্রমিকদের খোঁজখবর নিয়েছেন।

 

সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের চা শ্রমিকরা আন্দোলনে ব্যস্ত থাকায় বাগানের কাজকর্ম বন্ধ। কারখানাও তালাবদ্ধ। টিলা বাবুরা ছাড়া অফিসে তেমন লোকজন নেই। বেতনও হচ্ছে না শ্রমিকদের। শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে প্রতিটি শ্রমিক পরিবারে হাহাকার শুরু হয়েছে। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার চা বাগানগুলোর শ্রমিকরা বাগানের জঙ্গল থেকে সামান্য জ্বালানি কাঠ বিক্রি করে কোনোরকম জীবনটাকে সচল রেখেছেন। আর সিলেটের অনেক শ্রমিক এখন রিকশা চালাচ্ছেন। আবার অনেকেই কোনো কোনো সিকিউরিটি কোম্পানিতে গার্ডের দায়িত্ব নিয়েছেন।

 

হবিগঞ্জের দাড়াগাঁও চা বাগানের শ্রমিক কানু পাল জানান, বাগানে খাবার দেওয়ার কেউ নেই। আমরা খুব কষ্ট করে চলছি। কেউ খেয়ে, আবার কেউ না খেয়ে চলছে। পরিবারের ছেলে বুড়ো- সবাই কষ্ট করছেন।

 

সিলেট ভ্যালির শ্রমিকরা খুব কষ্টে আছেন। অধিকাংশ শ্রমিক জানান, অত্যন্ত কষ্টে চলছে তাঁদের দিন। সিলেট বুরজান চা বাগানের শ্রমিক মনিন্দ্র কুর্মী বলেন, অনেকেই বাগান থেকে কচু, কচুর মোড়া বা কচুর মুখি, লতা তুলে বাজারে বিক্রি করছেন। কেউ কেউ সিদ্ধ করে এগুলোই খাচ্ছেন।

 

সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা জানান, শ্রমিক নেতাসহ অনেকেই অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। আরও কিছুদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে সিলেটের বাগানগুলোতে করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মালিক পক্ষের বৈঠকের ফলাফলের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান।