উদ্বোধনের অপেক্ষায় খাগড়াছড়ির ৪২ সেতু

একটা সময় পাহাড়ি সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ অস্থায়ী ‘বেইলি সেতু’ ছিল একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত যেন নিত্যদিনের ঘটনা ছিল।

এতে মানুষের শঙ্কা ও দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন। তবে সময়ের সাথে বদলেছে পাহাড়ের চিত্র।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খাগড়াছড়ির অধিকাংশ পাটাতনের বেইলি সেতু সরিয়ে নির্মাণ করা হয় স্থায়ী সেতু।

সবশেষ জেলা উপজেলার আরও ৪২টি স্থায়ী সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পরিবর্তন আসবে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগে। ইতোমধ্যে সেতুগুলোর নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়। আগামী ২৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশের ১শ’টি সেতুর সঙ্গে খাগড়াছড়ির ৪২টি সেতু উদ্বোধন করবেন।

এ সংক্রান্ত চিঠি খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

বিভাগটির প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রাপ্ততথ্য মতে, খাগড়াছড়ির বিভিন্ন সড়কে পিসি গার্ডার সেতু, আরসিসি সেতু ও আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২শ ৩৮ কোটি ২৪ লাখ টাকায় ৪২টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এরমধ্যে দীর্ঘ সেতুটি হচ্ছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি সড়কের লোগাং সেতু।

১৪৩ দশমিক ৫ মিটারের দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এরপরের দীর্ঘতম মানিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ি সড়কে ১শ’ মিটার ধুরুং খাল সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি সড়কে ৭৯ দশমিক ৫মিটারের পুজগাং বাজার সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে কোটি ৩২ লাখ টাকা।
মাটিরাঙ্গা তানাক্কা পাড়া সড়কের ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের গোমতী সেতু নির্মাণে ব্যয় ৬ কোটি টাকা, মানিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ি সড়কে ৪৪ দশমিক ২ মিটার জুর্গাছড়ি সেতু নির্মাণে ব্যয় ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা, হেঁয়াকো-রামগড়-জালিয়া পাড়া সড়কে সোনাইপুল সেতু নির্মাণে ব্যয় ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা, দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি সড়কে ৪৪ মিটার দৈর্ঘ্যের পাবলাখালী সেতু নির্মাণে ব্যয় ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

 

একই সড়কে ৪৪ মিটার দৈর্ঘ্যের বাঘাইছড়ি সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ৪০ মিটার দৈর্ঘ্যের বাবুরোপাড়া সেতু নির্মাণে ব্যয় ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে ৩৭ মিটার দৈর্ঘ্যের পেরাছড়া ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, একই সড়কে ৩৭ মিটার দৈর্ঘ্যের গাছবান ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ৩৭ মিটার দৈর্ঘ্যের কুকিছড়া ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ৩৭ মিটার দৈর্ঘ্যের কুরাদিয়াছড়া ব্রিজ নির্মাণ ব্যয় ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, একই দৈর্ঘ্যের লতিবানছড়া ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

একই দৈর্ঘ্য ও ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে হাটহাজারি-মাটিরাঙ্গা সড়কের খাগড়াপুর ব্রিজ, রাঙামাটি-মহালছড়ি সড়কে ঠাকুরছড়া ব্রিজ, মানিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ির হাতিছড়া সেতু, জালিয়াপাড়া-মহালছড়ি সড়কের সিন্দুকছড়ি সেতু ও পঙ্খিমুড়া সেতু।

দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং সড়কের দেওয়ানছড়া সেতু নির্মাণ হচ্ছে ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকায়, বাঘাইহাট-মারিশ্যা সড়কের পতেঙ্গাছড়া সেতু নির্মাণ হয়েছে ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকায়, একই সড়কের নাকাপা সেতু নির্মিত হয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকায়, দীঘিনালা-বাবুছড়া সড়কের জারুলছড়ি সেতু নির্মিত হয়েছে ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকায়, মহালছড়ির চোংড়াছড়ি সেতু নির্মাণ হয়েছে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকায়, একই সড়কে মুসলিম পাড়া ব্রিজ নির্মাণ হয়েছে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকায়।

হেঁয়াকো-রামগড়-জালিয়াপাড়া সড়কে ৩১ মিটার দৈর্ঘ্যের পাতাছড়া সেতু নির্মাণ হয়েছে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকায়, জালিয়াপাড়া-সিন্দুকছড়ি সড়কে ২৮ মিটার দৈর্ঘ্যের ধুমনীঘাট সেতু ও যৌথখামার সেতু নির্মিত হয়েছে ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা করে ব্যয়।

 

দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং সগকে ২৮ মিটার দৈর্ঘ্যের বড়পেরা সেতু নির্মিত হয়েছে ৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকায়, খাগড়াছড়ি পানছড়ি সড়কে ২৫ মুটচর দৈর্ঘ্যের ছোটনালা ব্রিজ নির্মিত হয়েছে ৩ কোটি ৮ লাখ টাকায়। লক্ষ্মীছড়ি সড়কে ২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের মগাইছড়ি সেতু নির্মিত হয়েছে ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকায়, পানছড়ি সড়কে ২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের লোগাং বাজার সেতু নির্মিত হয়েছে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকায়, একই দৈর্ঘ্যের দীঘিনালার বুজ্যেনাল সেতু নির্মিত হয়েছে ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকায়, মগমারাছড়া সেতু নির্মিত হয়ছে ৪ কোটি ৯ লাখ টাকায়।

খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের ২২ মিটার দৈর্ঘ্যের পাকুজ্জাছড়ি ব্রিজ নির্মিত হয়েছে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকায়, মানিকছড়ি সড়কে ২২ মিটার দৈর্ঘ্যের দুল্লাতলী সেতু নির্মিত হয়েছে ২ কোটি ৭২ লাখ টাকায়, পানছড়ি সড়কের ১৯ মিটার দৈর্ঘ্যের ভাইবোনছড়া ব্রিজ ও কলাবাগান ব্রিজটি নির্মিত হয়েছে ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা করে ব্যয়ে। মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি সেতু ও তাইন্দং সেতু নির্মিত হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা করে ব্যয়ে।

খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কে ১৬ মিটার দৈর্ঘ্যের কৃষি গবেষণা সেতু নির্মিত হয়েছে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকায়, দীঘিনালা সড়কের হাতিমারাছড়া সেতু নির্মিত হয়েছে ৩ কোটি ৪১ লাখ টাকায়। ইতোমধ্যে সবগুলো সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। অপেক্ষা শুধু উদ্বোধনের।

খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান বলেন, দীর্ঘবছর আমরা ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে যানবাহন চালিয়েছি। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় বহু হতাহতের ঘটনাও আছে। অস্থায়ী সেতুর পাটাতনে ভেঙে গাড়ি আটকে যান চলাচর বিঘ্ন হতো। এখন সেসবের পরিবর্তন হয়েছে। যে কয়েকটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সেগুলোও স্থায়ী সেতুতে রুপান্তরিত হলো। এটি খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।

নারী উদ্যোক্ত ও সাম্পারি গ্রুপ অব ইনেসিয়েটিভর চেয়ারপার্সন শাপলা দেবী ত্রিপুরা বলেন, আশির দশকে সাময়িক সময়ের জন্য নির্মিত অস্থায়ী ব্রিজগুলো দিয়ে প্রায় ৩০ বছর জেলাবাসী যাতায়াত করেছে, কত দুর্ঘটনা ঘটেছে, কত প্রাণহানি হয়েছে তার হিসাব নেই। সেতুগুলো নির্মাণ হওয়ায় পর্যটকদের ভ্রমণ নিরাপদ হয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাজেকে যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়। তাই নিরাপদ যান চলাচলের জন্য স্থায়ী সেতু নির্মাণ খুবই প্রয়োজন ছিল।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুজন চাকমা বলেন, আগে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে অধিকাংশ সড়কে অস্থায়ী বেইলি ব্রিজ ছিল। ব্রিজের পাটাতন খুলে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটতো। আবার মেরামত করে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে কখনো কখনো এক থেকে দুইদিন লাগতো। এতে স্থানীয়দের কৃষিপণ্য পরিবহন, অসুস্থ রোগী পরিবহনসহ সাধারণ জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হতো। তবে এখন এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে জেলাবাসী।

খাগড়াছড়ি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কংজরী চৌধুরী বলেন, খাগড়াছড়ি কৃষি নির্ভর এলাকা। এখানকার উৎপাদিত কৃষি পণ্য সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। স্থায়ী সেতু হওয়ায় এখন ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তা মুক্ত থেকে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। যা সামগ্রিক অর্থে জেলাবাসী আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এটি সরকারের সুদূর প্রসারি চিন্তার ফসল।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সারাদেশের মতো খাগড়াছড়িতে সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তৎকালীন বেইলি ব্রিজ দিয়ে সড়কে যান চলাচল করতে কখন যাত্রীসহ সেতু ভেঙে যায় এই ভয়ে আমরা আতঙ্কে থাকতাম। এখন জেলা-উপজেলার সঙ্গে একদম নিরাপদ নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য জেলাবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।