নানা উদ্যোগেও প্রবাসী আয়ে হুন্ডির থাবা

dollar

বৈদেশিক মুদ্রার চরম সংকটের এই সময়ে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোও তৎপরতা বাড়িয়েছে। তবে কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। হুন্ডির কবলে পড়ে প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমছে। অক্টোবরে রেমিট্যান্স কমে ১৫৩ কোটি ডলারের নিচে নেমেছে, যা গত ৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। গত সেপ্টেম্বরে কমে তা ১৫৪ কোটি ডলারে নামে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, জনশক্তি রপ্তানি বাড়ছে, অথচ কমছে রেমিট্যান্স। এর প্রধান কারণ হুন্ডি। হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে দেশে তার সুবিধাভোগীর কাছে টাকা পৌঁছে দেয়। দেশে দেশে এভাবে হুন্ডিচক্রের সংগ্রহ করা ডলার দেশ থেকে অর্থ পাচারকারীরা কিনে নেয়, যা অর্থ পাচারের সবচেয়ে সহজ উপায় হিসেবে বিবেচিত। হুন্ডির এজেন্টরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ে বেশি দর দিয়ে থাকে।

ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা দর দিচ্ছে। হুন্ডি কারবারিরা সেখানে দিচ্ছে ১১০ থেকে ১১২ টাকা পর্যন্ত। আবার কোনো ঝামেলা ছাড়াই প্রবাসীর কর্মস্থল বা বাসায় গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে তারা। বিশ্বস্ততার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে এখানকার সুবিধাভোগীর এমএফএস বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং নগদে টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়। এসব কারণে এখন হুন্ডিতে ঝুঁকছেন প্রবাসীরা। আবার আমদানিতে বেশি দর দেখিয়ে অর্থ পাচার বন্ধের কঠোর উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে প্রবাসীদের আয়কে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের বড় উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, প্রবাসে শ্রমিক যাওয়া বাড়লেও রেমিট্যান্স কমছে- এটা হতে পারে না। হুন্ডিপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণেই এমন হচ্ছে। এ ছাড়া ডলারের কয়েকটি দর নির্ধারণের ফলে এমন হতে পারে। প্রবাসীরা দেখছেন, রেমিট্যান্সে ডলারের এক রকম দর; রপ্তানিতে আরেক রকম। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক ৯৭ টাকা দরে সরকারি ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে। খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে আরেক দরে। এতে প্রবাসীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। হুন্ডি বন্ধ করতে হলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না করে বক্তব্যবাজি করে লাভ হবে না। পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী- সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে মোট ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। গত বছরের একই মাসে এই পরিমাণ ছিল ১৬৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের বছরের একই মাসের চেয়ে কমেছে ১২ কোটি ১৫ লাখ ডলার বা ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৭২০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ১৪ কোটি ডলার বা ২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ বেশি। অথচ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও কমছে। সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ আগস্ট পর্যন্ত আমদানিতে প্রবৃদ্ধি আছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ব্যাপক চাপে পড়েছে।

 

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, রেমিট্যান্সে ১০৭ টাকা দর নির্ধারণ হুন্ডিকারবারিদের জন্য সহায়ক হয়েছে। কেননা, ডলার সংকট মেটাতে অনেক ব্যাংক এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১১০ থেকে ১১৪ টাকা পর্যন্ত দরে ডলার কিনছিল। দর একটু বেশি হলেও রেমিট্যান্স বাড়ছিল। অর্থ সংগ্রহে হুন্ডিকারবারিরা তখন ১১৫ টাকা বা তার বেশি দর দিচ্ছিল। তার পরও দর নির্ধারণের আগে রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবাহ ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় গত ১১ সেপ্টেম্বর সব ব্যাংকের জন্য রেমিট্যান্সে এক দর নির্ধারণ করা হয়। শুরুতে ১০৮ টাকা; সেখান থেকে দু’দফা ৫০ পয়সা করে কমিয়ে এখন সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় ডলার কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পর থেকে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমছে।

গত সোমবার বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংস্থাটির প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি ঠিক। কোনো কোনো পণ্য আমদানিতে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে। আবার শুল্ক্ক ফাঁকি দিতে গাড়িসহ কিছু পণ্য আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং হয়ে থাকতে পারে। রেমিট্যান্স কমার একটি কারণ হতে পারে গাড়ি আমদানির অর্থ পরিশোধ। যে কোনো উপায়েই হোক; একবার অর্থ পাচার হলে তা ফেরত আনা কঠিন।