বিশ্ব মন্দার প্রভাব নিয়ে সরকারের উদ্বেগ বাড়ছে

খাদ্যদ্রব্যসহ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে সৃষ্ট সংকট নিয়ে প্রতিনিয়তই সরকারের উদ্বেগ বাড়ছে৷ এই সংকটের আঘাত পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব না বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। তবে এই সংকট যাতে বেশি ক্ষতি করতে না পারে সেই চেষ্টাই করছে সরকার।

দুই বছরের বেশি সময় কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সারাবিশ্বের স্থবির অর্থনীতির কারণে সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার ওপর আসতে থাকে একের পর এক স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা)।

ফলে সারা বিশ্বে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। জ্বালানি সংকটের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে যা অব্যাহত রয়েছে।

আর এই পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কমতে শুরু করেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ডলারের মূল্য অনেক আগে ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে।

এদিকে আগামী বছর বৈশ্বিক সংকট আরও তীব্র হবে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে আশঙ্কা প্রকাশ করছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ না থামলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছাবে ওই সংস্থাগুলোর আশঙ্কা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে বার বার এই সংকটের সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছেন গত কয়েক মাস ধরে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, উন্নত ও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোতেও ইতোমধ্যেই এর প্রভাব পড়েছে ৷ চলমান সংকটে শক্ত অর্থনীতির ভীত দূর্বল হলেও ওই দেশগুলো হয় তো চরম সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। তবে দরিদ্র, স্বল্প উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই বেশি সংকটে, এমন কি চরম বিপর্যয়ে পড়তে হতে পারে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।

ওই সূত্রগুলো জানায়, বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেলসহ জ্বালানি সংকটের কারণে দেশে শিল্প উৎপাদন কমে যেতে পারে। পাশাপাশি অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির কারণে কৃষিতেও প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে সেচ কাজে। এসব কারণে সব ধরনের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে এবং বেকারত্ব বাড়বে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশঙ্কা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক মন্ত্রী জানান, জিনিসপত্রের দাম তো বেড়েই গেছে। সংকট কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন বড় চিন্তার বিষয়। তবে সরকার চেষ্টা করছে আগামীতে সংকটের প্রভাবটা যতটুকু কম রাখা যায়। রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল রপ্তানির আশ্বাস পাওয়া গেলেও নানামুখী চাপের আশঙ্কা থেকে সরকার সেদিকে আগাতে পারেনি। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি প্রক্রিয়াধীন। আগামী বছর মার্চের মধ্যে এই বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ভারত কিছু জ্বালানি তেল রপ্তানির আশ্বাসও দিয়েছে। সংকট উত্তরণে ভারতের এই বিদ্যুৎ-জ্বালানি দিয়ে অনেকটা ঘাড়তি মেটানো যাবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। অন্যান্য দিক থেকেও সরকার বিকল্প সাপোর্ট খুঁজছে বলে মন্ত্রী জানান।

এদিকে ডিজেল এবং এলএনজি’র (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) মূল্য বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোড শেডিং দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে শীত মৌসুমে বিদ্যুতের সংকট কমবে। এসময় বিদ্যুৎ চালিত শীতাতপযন্ত্র এবং পাখার ব্যবহার কমে যাওয়ায় কিছু বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। তবে ওই সময়ই অর্থাৎ ইরি মৌসুমে কৃষিকাজের সেচে বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়বে। ফেব্রুয়ারি-মার্চের সেচের সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ বিষয়টিও সরকারের চিন্তায় রয়েছে।

চলমান বৈশ্বিক সংকট আরও ঘনিভূত হলে এর ধাক্কা পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব না বলেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলেও এর চলমান সংকটের প্রভাব কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। সে বিষয়টি নিয়েও সরকারের চিন্তা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার চেষ্টা করছে বিশ্ব মন্দার ধাক্কাটা যাতে বেশি না লাগে, পরিস্থিতি যাতে প্রকট আকার ধারণ না করে। যত কম রাখা যায় সেই চেষ্টা সরকার সর্বাত্মকভাবে করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও সেটা উঠে এসেছে।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশের যাতে খুব বেশি ক্ষতি করতেন না পারে সেজন্য দেশবাসীকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার (৭ নভেম্বর) এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিচ্ছে তার ধাক্কা যেন বাংলাদেশের খুব বেশি ক্ষতি করতে না পারে। কারণ সেটার আঘাত তো লাগবেই এখন পৃথিবী একটা গ্লোবাল ভিলেজ, আমরা একইসঙ্গে। যদি সারাবিশ্বে দেখা দেয় সে অভিঘাতটা বাংলাদেশেও আসে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বলা হচ্ছে যুদ্ধ আরও দীর্ঘমেয়াদি হবে, তিন বছরও চলতে পারে। এটা হলে তো বিশ্বে আরও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে। আমরা তো গ্লোবাল ভিলেজে ঢুকে গেছি। উন্নত দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়ছে। ইউরোপের দেশের মতো অত রিজার্ভ নেই আমাদের। তারপরও তারা (ইউরোপ) তো রিজার্ভ ভাঙতে শুরু করেছে। আমাদের রিজার্ভ তো ৫০ বিলিয়নের কাছে গিয়েছিল। সেটা যদি ১০০ বিলিয়ন হত তাহলে হয়তো আমাদের চিন্তাটা আরও কম থাকতো। তারপরও সরকার সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা খাদ্য নিরাপত্তার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। সংকট চলে এলে সবাইকেই ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সরকার সে কারণে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছে।