মোশাররফ বললেন, অবসর নিয়েছি

টানা এক যুগ ফরিদপুর আওয়ামী লীগে ‘রাজত্ব’ করা ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে তাঁকে দলের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। সুইজারল্যান্ডে অবস্থান করা খন্দকার মোশাররফ গতকাল রোববার টেলিফোনে  জানান, রাজনীতি থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন।

এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে জানালেও কী কথা হয়েছে, বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। দুই দফায় আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী থাকা খন্দকার মোশাররফ বর্তমানে ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য। তবে তিনি সংসদে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদেও আছেন তিনি। টানা দুই বছর রাজনীতি থেকে তিনি নির্বাসনে ছিলেন।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৫১। তবে দলীয় সভাপতি চাইলে এ সংখ্যা বাড়াতে পারেন। এবার খন্দকার মোশাররফ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদ থেকে আর কেউ বাদ পড়েননি। সভাপতিম লী ও সম্পাদকম লী থেকে বাদ পড়া পাঁচজন নেতাকে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান দেওয়া হয়েছে। খন্দকার মোশাররফ প্রথমে প্রবাসীকল্যাণ, পরে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে তাঁকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী করা হয়। এর পর থেকে ২০২০ সালের ৭ জুন পর্যন্ত ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনিই ছিলেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর নির্দেশেই পরিচালিত হতো ফরিদপুরের রাজনীতি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই সময় তিনি ছিলেন ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির ১ নম্বর সদস্য।

২০২০ সালের ৭ জুন খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ফরিদপুর শহরের বদরপুরের বাড়িতে ও শহরের অন্যান্য স্থানে পুলিশ বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর প্রভাব বলয়ের কেন্দ্রে থাকা দুই সহোদর ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ কয়েকজন নেতাকে। এর দুই দিন পর ৯ জুন খন্দকার মোশাররফ ঢাকায় চলে আসেন। ওই বছর ১৪ জুলাই এক রাতের জন্য ফরিদপুর গিয়েছিলেন। এ সময় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন তাঁর মেয়ে। ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তাঁর চাচির জানাজায় অংশ নিতে এক রাতের জন্য ফরিদপুর গিয়েছিলেন তিনি। এর পর থেকে তিনি আর ফরিদপুর যাননি।

 

আড়াই বছর আগে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লেও অনুসারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ফিরে আসার প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। তবে গত দেড় বছর ধরে এসব প্রচারও বন্ধ। ফরিদপুরের রাজনীতিতে এখন আর খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নাম উচ্চারিত হয় না।

ফরিদপুরে দলের রাজনীতির নাটকীয় পরিবর্তনের পর দু’বছর জেলা আওয়ামী লীগ চলতে থাকে পুরোনো কমিটি দিয়েই। গত ১২ মে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে শামীম হককে সভাপতি এবং শাহ ইশতিয়াককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এখনও জেলা আওয়ামী লীগ চলছে দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি দিয়েই। জেলা বা কেন্দ্রে কোথাও কোনো কমিটিতে আর নেই মোশাররফ হোসেনের নাম। তাঁর আপন ভাই ফরিদপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর, এপিএস এএইচএম ফোয়াদ, ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেল বর্তমানে মানি লন্ডারিং মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে আছেন।

 

ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের এক বর্ধিত সভায় মোশাররফ হোসেন সম্পর্কে বলেন, ‘ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন নেমে এসেছিল। আওয়ামী লীগের নির্যাতিত-নিপীড়িত নেতাদের যে দীর্ঘশ্বাস, তার ফল আজ আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে ফরিদপুরে কোনো রাজনীতি ছিল না। যাঁরা রাজনীতি করেছেন বা করতে চেয়েছেন, তাঁদের তা করতে দেওয়া হয়নি। আরেক দল ছিল, যারা সব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে রাজনীতি করেনি; লুটপাট করেছে। এই দুইয়ের সংঘাতে ফরিদপুরে রাজনীতি ছিল একেবারে অনুপস্থিত।’

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামীম হক এ প্রসঙ্গে বলেন, দলে কে থাকবে আর কে বাদ পড়বে- এটা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনায় হয়। কেউ বয়সের বিবেচনায়, কেউ অসুস্থতার কারণে, আবার কেউ প্রত্যাশা অনুযায়ী দলের জন্য অবদান না রাখায় বা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে দল থেকে বাদ পড়ে যান। খন্দকার মোশাররফ এমপি থাকা অবস্থাতেই যেহেতু দলের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হয়েছেন; এটা দলের শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্তেই হয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের ৭ জুন ফরিদপুরে পুলিশের বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। ওই হামলার জন্য সুবল চন্দ্র দলের তৎকালীন প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। খন্দকার মোশাররফের লোকদের নামে প্রথম মামলা করা এ প্রবীণ নেতা বলেন, শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষণ। তিনি জেনেবুঝেই খন্দকার মোশাররফকে দল থেকে বাদ দিয়েছেন।

খন্দকার মোশাররফ বর্তমানে জেনেভায় আছেন মেয়ের কাছে। সেখানে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করাচ্ছেন জানিয়ে তিনি সমকালকে বলেন, ‘বয়স তো হয়ে গেছে অনেক- ৮৫ বছর। আর কত পারা যায়! তা ছাড়া মানুষ তো রিটায়ার করে কর্মজীবন শেষে। রাজনীতি করতেও বয়স লাগে।’ কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর তাঁর নাম দলের কোনো তালিকায় দেখা যায়নি উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই বলেছি আমাকে না রাখতে। বয়সের কারণে আমি স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছি।’

সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, খন্দকার মোশাররফ সর্বশেষ জাতীয় সংসদের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন গত ৬ এপ্রিল। এটি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশন। এর পর বাজেট অধিবেশনসহ তিনটি অধিবেশন হয়েছে। তবে কোনোটিতেই উপস্থিত ছিলেন না খন্দকার মোশাররফ হোসেন।